বগুড়া: জেলার খাল-বিল আর জলাবদ্ধ ভূমিতে ভাসছে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর পানিফল। জলজ এই ফল বগুড়ার চাষিদের কাছে এখন সোনার ফসল হয়ে উঠেছে। পানিফল চাষ করে ভালো আয়ের সম্ভাবনা দেখছেন স্থানীয় কৃষকরা। অল্প পুঁজিতে বেশি লাভ হওয়ায় পানিফল চাষে দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে। জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্যান্য জেলাগুলোতেও বিক্রি করা হচ্ছে এ ফল। পানিফল শিশু থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধরাও খেতে পছন্দ করেন। খেতে সুস্বাদু ও মিষ্টি হওয়ায় চাহিদাও বেশি।
জানা যায়, গ্রাম-বাংলার জলাভূমিতে বেড়ে ওঠা এই পানি ফল সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। এটি দেখতে সিঙাড়ার মত বলে স্থানীয়ভাবে পানিফলের নাম ‘সিঙাড়া’ নামেই পরিচিত। এ ফল শীতের শুরুতে বাজারে ওঠলেও এখন আগাম চাষ হচ্ছে। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার পূর্বে দোবিলা বিলে পানিফলের চাষ করছেন স্থানীয় চাষীরা। এছাড়া জেলার গাবতলী, নন্দীগ্রাম, সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় পানিফল উৎপাদনে সফলতা পাওয়ায় চাষিরা অনুপ্রাণিত হয়ে কৃষি অফিস থেকে চাষাবাদ পদ্ধতি শিখে পতিত জমিতে পানিফল চাষ করেছেন। নিচু পতিত জমি এবং বিল-জলাশয়ে মৌসুমি ফসল হিসেবে পানিফল চাষ হচ্ছে। স্বল্প খরচে অনেকটা লাভবান হওয়ার আশায় কৃষকদের মাঝে আগ্রহ বেড়ে গেছে পানিফল চাষের। চাষও যেমন বাড়ছে তেমিন বাজারে এই ফলের দাম ভালো। আর ভালো দাম পেয়ে কৃষরাও খুশি।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, বর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ পানিফলের গাছ পাঁচ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পানির নিচে মাটিতে শিকড় থাকে আর পানির ওপর ভাসতে থাকে পাতাগুলো। পানির ওপর গোলাকারভাবে ভেসে থাকা পাতাগুলোকে দূর থেকে দেখতে অনেকটা শিঙাড়ার মতো দেখায়। আর এই পাতার নিচেই লুকিয়ে আছে ত্রিকোণাকৃতির পানিফল। বিভিন্ন পতিত ডোবা, খাল, পুকুরের স্বল্প পানিতেই এই ফল চাষ করা যায়। আষাঢ় মাসের বৃষ্টিতে যখন জলাশয়গুলোতে পানি জমতে শুরু করে তখন পানিফলের চারা ছেড়ে দেওয়া হয়। এর তিন মাস পর (ভাদ্র মাস থেকে) গাছে ফল আসা শুরু করে। প্রতি গাছ থেকে ৩/৪ বার ফল তোলেন চাষীরা। পৌষ মাস বা ডিসেম্বর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। এ ফলের কোনো বীজ নেই। মৌসুম শেষে পরিপক্ব ফল থেকে আবারো চারা গজায়। সে চারা পরে জলাশয়ে লাগানো হয়।
কৃষকরা আরও জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছর জেলায় পানিফলের বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রতি বিঘায় ১৭ থেকে ২০ মণ ফল হচ্ছে। বিঘাপ্রতি ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতি মণ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে কেনা-বেচা হয়ে থাকে। তবে মৌসুমের শুরুতে দাম ভালো পাওয়া যায়।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় ৩৫ হেক্টর জমিতে পানিফল চাষ হয়েছে। যা থেকে ৯০০ মেট্রিকটন ফল উৎপাদন হবে। গত বছর জেলায় ৩০ হেক্টর জমিতে পানিফল চাষ হয়েছিল। গত বছরের তুলনায় এবার ৫ হেক্টর জমিতে বেশি চাষ হয়েছে। বর্তমানে বগুড়ায় বানিজ্যিভাবে চাষ করা হচ্ছে পানিফলের। কৃষি প্রধান এই জেলায় সারা বছরই কিছু কিছু জমি ও বিলে হাঁটুসমান পানি থাকে। ফলে শীতকাল এলেই পানিফল চাষে ব্যস্ত হয়ে পড়েন চাষিরা।
বগুড়া সদরে সামগ্রাম দক্ষিণপাড়ার পানিফল চাষী শফিকুল ইসলাম জানান, তারা ৫ জনে মিলে দোবিলা বিলে ১৪ বিঘা জমিতে পানিফলের চাষ করেছেন। ১৪ বিঘা জমিতে তাদের খরচ হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা। ১ থেকে দেড় মাসে এখান থেকে তারা দুই লাখ টাকার বেশি ফল বিক্রি করতে পারবেন। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ মন করে পানি ফল বাজারে বিক্রি করেন। পাইকারি বাজারে প্রতি মন পানিফল বিক্রি করেন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।
তিনি আরও জানান, এবার ফলন ভালো হয়েছে। বাজারে চাহিদাও ভালো। অন্যান্য ফসলের চেয়ে খরচ অনেক কম। পরিচর্যাও তেমন করতে হয় না। শহর এবং গ্রামে সবখানেই এ ফলের চাহিদা রয়েছে। সেদ্ধ করেও এ ফল খাওয়া যায়।
এদিকে বগুড়ার বিভিন্ন বাজারে খুচরা বিক্রেতারা প্রতি কেজি পানি ফল বিক্রি করছেন ৩০টাকা কেজি দরে। সুস্বাদু ও পুষ্টিগুন হওয়ায় পরিবারের জন্য অনেকেই কিনছেন এই ফল।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম ফরিদ জানান, এ বছর জেলায় ৩৫ হেক্টর জমিতে পানিফল চাষ হয়েছে। যা থেকে ৯০০ মেট্রিকটন ফল উৎপাদন হবে। গত বছর জেলায় ৩০ হেক্টর জমিতে পানিফল চাষ হয়েছিল। গত বছরের তুলনায় এবার ৫ হেক্টর জমিতে বেশি চাষ হয়েছে। অন্য ফসলের চেয়ে পানিফল চাষে কষ্ট কম হয়। কীটনাশক ও সার কম ব্যবহার হওয়ায় এটি পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাবার।
তিনি বলেন, ছোট-বড় সবাই এই ফল খেয়ে থাকেন। এর মধ্যে খনিজ পদার্থ আছে। যেটা শরীরের জন্য উপকারী। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যেন তারা বাণিজ্যিকভাবে এই পানিফল আবাদ করে লাভবান হতে পারেন।