সিলেট: পাবনায় নিশি নামে এক নারী ৮টি নিরীহ কুকুরছানাকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন, অন্যদিকে সিলেটে মাত্র ১০ বছর বয়সী শিশু সামিন দেখিয়েছে প্রাণির প্রতি অপরিসীম মমতা।
সিলেট শহরে বেড়ে ওঠা সাইহান সামিন বর্তমানে নগরীর খাসদবির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে।
বয়সে ছোট হলেও দায়িত্ববোধে অনেক বড় সে। স্কুল থেকে ফিরেই ব্যাগ নামানোর আগেই ছুটে যায় তার কুকুরগুলোর কাছে, কেউ ক্ষুধার্ত কিনা, কেউ অসুস্থ কিনা, কার পানি কমে গেছে, সব নিজ হাতে দেখে। পড়াশোনা, খেলাধুলা আর প্রাণী পরিচর্যা-এই তিনটিকে সমানভাবে সামলানো তার প্রতিদিনের রুটিন।
শিক্ষক ও সহপাঠীদের কাছেও সামিন পরিচিত একজন প্রাণীপ্রেমী হিসেবে, যার বয়সকে হার মানিয়েছে তার হৃদয়ের বড়ত্ব।
সেই ছোট্ট প্রাণপ্রেমী “সাইহান সামিন” দেখিয়ে দিয়েছে, দয়া ও ভালোবাসা থাকলে মানুষই পারে পথ প্রাণীদের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় করতে।
সিলেট শহরের আম্বরখানা বড়বাজার এলাকার গোয়াইটুলায় সামিনদের বাসায় ঢুকতেই প্রথম চোখে পড়ে গেইটের সতর্কবাণী, “কুকুর হইতে সাবধান।” আর ভেতরে পা রাখতেই দেখা যায় এক অনন্য জগত, কখনো খুশিতে ল্যাজ নাড়া, কখনো ছুটে এসে অভ্যর্থনা, আবার কারো চোখে মায়া করে তাকানো। একেকটি কুকুরের নিজস্ব নাম, আলাদা আচরণ, আলাদা গল্প। টারজান, কাল্লু, চিংকু, লাল্লি, বল্টু সবাই যেন সামিনের পরিবারের সদস্য।
বছর কয়েক আগে ছোট্ট সামিন বাড়ির সামনের রাস্তায় তিনটি বাচ্চা কুকুর দেখতে পায়। নাম দেয় লালু, কালু ও ডন। প্রতিদিন খাবার দিয়ে, কোলে করে, সময় দিয়ে তাদের বড় করতে করতে একসময় সংখ্যাটি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কেউ অসুস্থ ছিল, কেউ ফেলে যাওয়া, কেউ গাড়ির ধাক্কা খেয়ে আহত সবাইকে আশ্রয় দিয়েছে সামিন।
আজ সেই সংখ্যা অর্ধশতাধিক।
গল্পে গল্পে ছোট্ট সামিন বলেন, “ওরা কথা বলতে পারে না, তাই ওদের জন্য আমার মন কাঁদে। সবাই ওদের ভয় পায়, কেউ মারধরও করে। কিন্তু ওরা আমার কাছে পরিবার।” তার চোখে প্রাণীদের জন্য এক অদ্ভুত কোমলতা।
সাইহান সামিনের বাবা সাদিকুর রহমান সাকী বলেন, “ছোটবেলা থেকেই ওর প্রাণীদের প্রতি মায়া। আমরা প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম, এতগুলো কুকুর সামলাবে কীভাবে? কিন্তু দেখলাম প্রতিদিন সময় দিয়ে, খাওয়ানো থেকে সেবা সবই ও করার চেষ্টা করে। আমরা শুধু সহযোগিতা করি।”
তিনি আরও বলেন, “আজকের সমাজে যেখানে আমরা মানুষের মধ্যেও নিষ্ঠুরতা দেখি, সেখানে আমার ছেলে ভালোবাসার এক জীবন্ত উদাহরণ।”
তার মা সূবর্ণা হামিদ বলেন, “শিশুরা সাধারণত খেলনা নিয়ে খেলে, কিন্তু আমাদের সামিন পশুপাখি নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
তিনি আরও যোগ করেন, “অনেকে বলে কুকুর রাখলে সমস্যা হয়। কিন্তু আমি দেখি, এই পশুগুলোই আমাদের বাড়িকে আনন্দে ভরিয়ে রাখে।” প্রাণীপ্রেমের পাশাপাশি সামিন নিয়মিত অংশ নেয় বিভিন্ন প্রাণীসম্পদ মেলায়। সামিন পেটস কেয়ার নামে সে জেলা পর্যায়ে ‘সেরা প্রদর্শক’ হিসেবে পুরস্কারও পেয়েছে।
একদিকে নিষ্ঠুরতা, যেখানে অমানবিকভাবে কুকুরছানা হত্যা করা হয়। অন্যদিকে সামিন যে নিজের শিশুকণ্ঠে বারবার বলে, “প্রাণের তো দাম আছে, ওরা তো আমাদের মতোই ব্যথা পায়।”
সামিনের বাড়ি কেবল কুকুরের আশ্রয়স্থল নয়, মানবিকতারও আশ্রয়স্থল। তার এই কাজ সমাজকে শেখায় দয়া কখনো ছোট হয় না, আর হৃদয়ের বড়ত্ব বয়স দিয়ে মাপা যায় না।