ঢাকা: ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। এ দিন ভুটান ও ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ফলে রণাঙ্গন আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মিত্রবাহিনীর আক্রমণে দিশাহারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিভিন্ন সীমান্ত ঘাঁটি থেকে পালাতে থাকে। এক পর্যায়ে তাদের পরাজয় শুধুই সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
আনুষ্ঠানিকভাবে সবার আগে ভুটান বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃত দিয়েছিল। এর কয়েক ঘণ্টা পর স্বীকৃতি দেয় ভারত। সেদিন লোকসভায় দাঁড়িয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বলেন, ‘সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করার পর স্থায়ী মন্ত্রিসভার বৈঠকে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধুমাত্র ভাবাবেগে পরিচালিত হয়ে নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে বিচার করেই স্বীকৃতি দিচ্ছি।’
এ দিন মিত্রবাহিনী বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌবাহিনী শুরু করে নৌ অবরোধ। দশম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কর্নেল জাফর ইমামের নেতৃত্বে ফেনী মুক্ত করেন। মেজর জলিলের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা সাতক্ষীরা মুক্ত করে খুলনার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ঝিনাইগাতির আহম্মদ নগর হানাদার বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করেন কোম্পানি কমান্ডার মো. রহমতুল্লাহ।
পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও মুক্ত হয় এদিন। লাকসাম, আখাউড়া, চৌদ্দগ্রাম, হিলিতে মুক্তিবাহিনী দৃঢ় অবস্থান নেয়। রাতে আখাউড়া ও সিলেটের শমসেরনগর যৌথবাহিনীর অধিকারে আসে। ঝিনাইদহ শহর শত্রুমুক্ত করে যৌথবাহিনী। এ দিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মিত্ররাষ্ট্র ভারতের জওয়ানদের অভিনন্দন জানান। অন্যদিকে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ায় ভারতের সঙ্গে তাৎক্ষণিক কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে পাকিস্তান। আর ভারতে মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশের একটি টেলিফোন আসে ভারতের ইস্টার্ন আর্মির চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জ্যাকবের কাছে। জেনারেল জ্যাকবকে সেনাপ্রধান মানেকশ বার্তা দেন, ‘পাকিস্তানি বিমান থেকে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে এয়ারফিল্ডগুলোতে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে।’ সে সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বিষয়টি অবহিত করার জন্য জেনারেল জ্যাকবকে পরামর্শ দেওয়া হয়। ওই সময় ভারতের ভেতরে বোমা ফেলার খবরে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা মোটেও উদ্বিগ্ন বা বিচলিত ছিলেন না। বরং এ ধরনের একটি সংবাদের জন্য ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা অপেক্ষায় ছিলেন।
তখন সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘণ্টা। এর পর মাত্র ১৩ দিনের যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তার আগে থেকেই ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই পশ্চিম সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করা শুরু করে। কারণ, তখন পরিস্থিতি এমন ছিল যে, যেকোনো সময় দুই দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে যাবার আশঙ্কা করা হচ্ছিল।
ভারত না ভুটান— কারা প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল? এ নিয়ে বিতর্ক ছিল দীর্ঘ দিন। কারও মতে, ভুটান ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আবার কারও মতে, ভারত ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, পরদিন ৭ ডিসেম্বর দিয়েছিল ভুটান। প্রকৃতপক্ষে দু’টি দেশই ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তবে ভারতের স্বীকৃতির কয়েক ঘণ্টা আগে তারবার্তার মাধ্যমে ভুটান স্বীকৃত দিয়েছিল বাংলাদেশকে। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে সবার আগে ভুটানই বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃত দিয়েছিল।