১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর। এ দিন কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর, তথা বৃহত্তর কুমিল্লা মুক্ত হয়। এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করে। তবে তখনো অবরুদ্ধ ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সেনাদের নিষ্ক্রিয় অবস্থান ছিল।
এদিন কুমিল্লা বিমানবন্দরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থানের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা আর্টিলারি আক্রমণ চালায়। এক পর্যায়ে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। রাতভর প্রচণ্ড যুদ্ধে ২৬ মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। এদিকে যুদ্ধে পরাজিত হানাদার বাহিনীর কিছু সদস্য বিমানবন্দরের ঘাঁটি ত্যাগ করে শেষ রাতে বরুড়ার দিকে ও সেনানিবাসে ফিরে যায়। আর কুমিল্লা বিমানবন্দরের ঘাঁটিতে ধরা পড়া কতিপয় পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে।
ওইদিন কুমিল্লার রাস্তায় নেমে আসে জনতার ঢল। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ফুলে দিয়ে বরণ করে নেয় আপামর জনসাধারণ। বিকেলে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। তৎকালীন পূর্বাঞ্চলের প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জহুর আহমেদ চৌধুরী দলীয় পতাকা এবং মুক্ত কুমিল্লার প্রথম প্রশাসক অ্যাডভোকেট আহমদ আলী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
এদিন যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত হওয়ার পর সর্বত্র ওড়ানো হয় লাল-সবুজের পতাকা। বিজয়ের আনন্দে স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। চাঁদপুরেও বিজয়ের সুবাতাস বইতে থাকে। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা ট্যাংক নিয়ে চাঁদপুরে প্রবেশ করে এবং পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়। চাঁদপুর সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়।
ওই সময় পর্যন্ত কিছু বিচ্ছিন্ন জায়গা ছাড়া মেঘনা নদীর পূর্বপার মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর তখনো মুক্ত হয়নি। অবশ্য পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি তিতাস-ডোলভাঙা নদীবেষ্টিত বাঞ্ছারামপুর থানা মুক্তিযোদ্ধারা অবরুদ্ধ করে রাখে।
এদিন যশোর ক্যান্টনমেন্ট মিত্র ও মুক্তিবাহিনী দখল করে নেয়। দাউদকান্দি, ইলিয়টগঞ্জ, বিদ্যাকূট, মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল, সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), হাজিগঞ্জ, মিরসরাই (চট্টগ্রাম), ঝালকাঠি, কালকিনি (মাদারীপুর), দৌলতপুর (কুষ্টিয়া), মিরপুর (কুষ্টিয়া), মেলান্দহ (জামালপুর), মাগুরাও মুক্ত হয় এদিন। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সবেধন নীলমনি দুটি স্যাবার জেট মিত্রবাহিনী ভূপাতিত করে।
দেশের একেকটি প্রান্ত জয় করে মিত্র ও মুক্তিবাহিনী ঢাকার দিকে ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসতে থাকে। পুরো দেশ থেকে বিজয় ও মুক্ত এলাকার তাজা খবর আসতে থাকে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে যৌথবাহিনীকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত রক্ত গরম করা রণসংগীত বাজাতে থাকে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সব জায়গায় পরাস্ত হতে থাকে। একে একে তারা অবরুদ্ধ হয়ে আত্মসমপর্ণ করতে থাকে। এ দিন হানাদার বাহিনীকে লক্ষ্য করে বিমান থেকে আত্মসমর্পণের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দলখলদার বাহিনীর উদ্দেশে যৌথবাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল মানেকশের লেখা ওই বার্তায় দ্রুত আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। সেইসঙ্গে এ আশ্বাসও দেওয়া হয়, আত্মসমর্পণ করলে তাদের প্রতি জেনেভা কনভেনশনের রীতি অনুযায়ী সম্মানজনক আচরণ করা হবে।
যদিও রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা চাইছিলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এভাবে আত্মসমর্পণ না করুক। যুদ্ধের মাধ্যমে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে বাংলার মাটিতে তাদের উচিত শিক্ষা দেওয়া ছিল মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্য। মুক্তিযোদ্ধাদের মনের এই অবস্থা ঠিকই বুঝে ফেলে মিত্রবাহিনী। তখন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্ত এলাকার জনগণের উদ্দেশে শৃঙ্খলা বজায় রাখার নির্দেশনা প্রচার করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার।