ঢাকা: সরকার ঘোষিত সময় অনুযায়ী, আসছে ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। সেজন্য প্রস্তুতিও সেরে ফেলেছে নির্বাচন কমিশন। এমনকি আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে সাংবিধানিক এই সংস্থাটি। কিন্তু নির্বাচনের জন্য ইসির পাশাপাশি কতটা প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী?- সে প্রশ্নই বারবার উঠে আসছে।
কারণ, নির্বাচনকালীন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়। ওই সময়ের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে বিভিন্ন মহলে মতভেদ ও আশঙ্কা রয়েছে। তবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গির আলম চৌধুরী বারবার আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেখানে যেভাবে ঠিক করা দরকার তাই করা হয়েছে। সামনে এর দৃশ্যমান অবস্থাটা দেখতে পাবে সবাই।’
জানা গেছে, এরই মধ্যে ৬৪ জেলার পুলিশ সুপার বিনা তদবিরে বদলি করা হয়েছে। ডিআইজি ও এডিশনাল ডিআইজি পদে রদবদল হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ মেট্টোপলিটন এলাকায় ওসিদের পরিবর্তন করা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম ডিএমপির ৫০ থানায় একদিনে সকল ওসিকে বদলি করা হয়।
নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে মাঠ পর্যায় থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও সাধারণ প্রেক্ষাপট অনুযায়ী কিছু বিষয় নিয়ে আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আলোচনায় কিছু বিষয় উঠে এসেছে।
চ্যালেঞ্জ ও অবনতির আশঙ্কা
নির্বাচনের সময়, বিশেষ করে তফসিল ঘোষণার পর, রাজনৈতিক সংঘাত, সংঘর্ষ ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা তৈরি হয়। কিছু রাজনৈতিক দল এবং বিশ্লেষক মনে করেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ‘সবার জন্য সমান ক্ষেত্র’ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড)-এর অনুপস্থিতি, প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে পরিস্থিতি জটিল হতে পারে।
সরকারের প্রস্তুতি ও আশ্বাস
সরকারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মাধ্যমে প্রায়ই আশ্বাস দেওয়া হয় যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে এবং নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর করতে সবধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনকালীন সমন্বয়ের জন্য কন্ট্রোলরুম স্থাপন, প্রতিটি কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি, এবং মোবাইল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স প্রস্তুত রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখার চ্যালেঞ্জ
নির্বাচনকালীন আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখা নির্বাচন কমিশনের জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই সময় অর্থ ও পেশীশক্তির নিয়ন্ত্রণ, জালভোট/ভোটকেন্দ্র দখল রোধ, এবং সব রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর জন্য নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনি প্রচারের সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও সরকার আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সেগুলো হলো-
পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার এবং ক্ষেত্রবিশেষে সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ড মোতায়েন করা হবে। নির্বাচনি আচরণবিধি ও আইন প্রয়োগের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ভোটকেন্দ্রে নজরদারি বাড়াতে সিসিটিভি ক্যামেরা ব্যবহার করে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের সিদ্ধান্তও হয়েছে। এছাড়া, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জেলা পর্যায়ের প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তদারকি করা হবে।
অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের চ্যালেঞ্জ
নির্বাচনকালীন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, রাজনৈতিক পরিবেশ, অংশগ্রহণকারী দলগুলোর আচরণ এবং নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভূমিকার ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। নির্বাচনকালীন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে জোর ভূমিকা পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
২০২৪ সালের আগস্টে দেশজুড়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশ স্থাপনা থেকে বিপুল সংখ্যক অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়ে যায়। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিতভাবে অভিযান চালিয়ে সফলতা দেখালেও, সম্প্রতি লুণ্ঠিত অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ উদ্ধার এখনো বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।
জানা গেছে, ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় ৫ হাজার ৭৬৩টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬ লাখ ৫২ হাজার আটটি গোলাবারুদ/গুলি লুট হয়। এর মধ্যে ৪ হাজার ৪২৩টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। এখনো উদ্ধার হয়নি ১ হাজার ৩৪০টি অস্ত্র। অন্যদিকে, গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭২৮টি। এখনো উদ্ধার করা যায়নি ২ লাখ ৫৭ হাজার ২৮০টি গোলাবারুদ/গুলি।
এদিকে উদ্ধার না হওয়া অস্ত্রের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডাররা। কারণ, উদ্ধার না হওয়া এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ সন্ত্রাসী, জেল পলাতক আসামি, চরমপন্থী গোষ্ঠী এবং কিশোর গ্যাংয়ের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার, খুন-ডাকাতি, ছিনতাই ও নির্বাচনকালীন সহিংসতায় এসব অস্ত্রের ব্যবহার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে এবং সাধারণ জনগণের কাছ থেকে তথ্য পেতে আর্থিক পুরস্কারও ঘোষণা করেছে। এরপরও অস্ত্র নিয়ে কেউ নিজেই থানায় হাজির হননি। এমনকি কেউ অস্ত্রধারীকে ধরেও দেননি। অর্থাৎ পুরস্কার ঘোষণা করেও কোনো অস্ত্র জমা পড়েনি। তার মানে অবশ্যই অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরির্দক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, ‘আগামীর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুলিশ সবধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। এ মাসেই পুলিশের প্রশিক্ষণ শেষ হয়ে যাবে। একেকজনের দায়িত্ব একেকরকমভাবে বিন্যাস করা হয়েছে। তারা সে অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবে।’
ভোটকেন্দ্র মনিটরিংয়ে কোথাও সিসি ক্যামেরা, কোথাও বডি ক্যামেরা, আবার কোথাও ভ্রাম্যমাণ ক্যামেরা ব্যবহার করা হবে বলে জানান তিনি।