ঢাকা: বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রবক্তা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তার হাত ধরেই এদেশে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের নতুনধারা সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই ধারা বয়ে নিয়ে এসেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় বর্তমানে দলটির হাল ধরে আছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। যদিও রাজনৈতিক টানাপোড়েনের গ্যাঁড়াকলে পড়ে তাকে প্রায় দেড় যুগ প্রবাস জীবন কাটাতে হয়েছে। তবে ‘২৪-এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান তার সেই প্রবাস জীবনের ইতি কাটাতে বিশাল ভূমিকার রেখেছে। অবশেষে দেশে ফিরছেন বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমান।
দীর্ঘ প্রবাস জীবনের ইতি টেনে আগামী ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরবেন তিনি। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যেবোধে বিশ্বাসীদের জন্যে এটি একটি ঐতিহাসিক দিন। দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর তিন মাস পর বাংলাদেশে ফিরছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার একমাত্র উত্তরসূরি তারেক রহমান। দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে বিএনপি‘র পক্ষ থেকে ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। দেশবাসী প্রতীক্ষা করছে কখন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ক্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারেক রহমানে দেশে ফেরা বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দল-বিএনপির জন্য বড় ট্রাম্পকার্ড। এই কার্ড কাজে লাগাতে পারলে আগামীতে সরকার গঠন করা দলটির জন্য অনেকটা সময়ের ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে। কারণ, বিএনপি‘র দীর্ঘদিনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। কারণ, তাদের কার্যক্রম সাময়িক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনেক অবশ্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও সমমনা ইসলামী দলগুলোকে এই মুহূর্তে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছে। তবে এর প্রমাণ দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
২০০৭ সালের জানুয়ারিতে সেনাসমর্থিত সরকার দুর্নীতির অভিযোগে তারেক রহমানকে গ্রেফতার করে। ১৮ মাস কারাগারে থাকার পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মুক্তি পান তিনি। এর এক সপ্তাহ পর ১১ সেপ্টম্বর চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান। সেই সময় থেকেই লন্ডনে অবস্থান করছেন তিনি। দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর তিন মাস পর তিনি দেশে ফিরছেন তারেক রহমান। ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রিয় নেতার দেশে ফেরার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। কিন্তু এই দেড় বছরেও তার ফেরার তারিখ ঠিক ছিল না। তখন অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, তার মা বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ, কেন দেশে ফিরছেন না তারেক রহমান? যদিও চলতি বছরের প্রথম দিকে তার মা-ই লন্ডনে যান চিকিৎসার জন্য। সেখানে প্রায় ছয় মাস চিকিৎসা নিয়ে দেশেও ফেরেন তিনি। অনেকে মনে করেছিলেন ওই সময় দেশে ফিরতে পারেন তারেক, তবে তার ফেরা হয়নি।
কিন্তু দেশে ফেরার কিছুদিন পর বেগম খালেদা জিয়া ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন। বর্তমানে তিনি রাজধানীর এভার কেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকরা বলছেন, তার শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। মায়ের এই অসুস্থতার সময় ছেলে পাশে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারেক রহমান কিছুদিন আগে তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে লিখেন, ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়’। তখন সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, অন্তর্বর্তী সরকার তার দেশে ফেরা নিয়ে কোনো সমস্যাও দেখছে না। কিন্তু তার ফেরা নিয়ে নিরাপত্তার বিষয়টি বারবার সামনে চলে আসে। তারপরও তার ফেরা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ট্রল হয়েছে।
তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে তারেক রহমান ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন তিনি। যদিও গত ১২ ডিসেম্বর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে নির্মমভারে গুলি ও ১৮ ডিসেম্বর তার মৃত্যু দেশবাসীকে উপলব্ধি করিয়ে দিয়েছে তারেক রহমান দেশে ফেরা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরও দেশ ও জাতির প্রয়োজনে দেশে ফিরছেন তিনি। এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে তার সর্বোচ্চ নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তো থাকছেই।
প্রবাসে থাকা যে কতটা কষ্টের তা অন্য কারও বোঝার কথা নয়। বিএনপি‘র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মা বেগম খালেদা জিয়া বিগত ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসন জুড়ে আওয়ামী লীগের আক্রোশের শিকার হয়ে মিথ্যা মামলায় দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন। সন্তান হিসেবে তার মায়ের সংকটাপন্ন অবস্থায় ছুটে আসারই কথা। এর ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। তবে এটাতে নিশ্চয়ই কিছু জটিলতা বা প্রতিবন্ধকতা আছে, যার জন্য তার দেশে আসা বারবার পিছিয়ে গেছে।
এদিকে জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশ রাজনীতি এক নতুন বিন্যাস লক্ষণীয়। জনগণের ভোটে এই সময়ে ক্ষমতা যেতে পারবে না- একটা শক্তি সেটা ধরেই নিয়েছে। যদিও নতুন রাজনৈতিক শক্তির বিন্যাসের তারা ক্ষমতার কাছাকাছি চলে গেছে। তারা তারা মনে করছে, নির্বাচন যত দীর্ঘায়িত হবে তাদের ক্ষমতা দখল তত সুনিশ্চিত হবে। তাই তারা ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে। যে করে হোক নির্বাচন বানচাল কিংবা বিলম্বিত করতে সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছে। ভূ-রাজনীতি বিবেচনায় দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করুক, এটা বিদেশি কোনো মহলের এজেন্ডা হতে পারে। দেশের রাজনীতি দেশি-বিদেশি চক্রান্তের একটা জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে গেছে। এই অবস্থায় নির্বাচন যতই দ্রুত হবে ততই দেশের জন্য। কারণ, বর্তমানে নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নেই।
ওসমান হাদির ওপর হামলা এই চক্রান্তের একটা অংশও বলা যায়। এছাড়া হাদির মৃত্যুর পর তার প্রতি আবেগ ও ক্ষোভকে কেন্দ্র করে একটা গোষ্ঠীর প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানটসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলার ঘটনা উল্লিখিত ষড়ন্ত্রেরই অংশ বলে মনে করা হচ্ছে। দেশে নির্বাচিত সরকার না থাকায় এমনিতেই বিদেশি বিনিয়োগ থমকে আছে, দেশি বিনিয়োগও হচ্ছে না। বেকারের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। দেশের এই সংকট উত্তরণে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। আসন সংখ্যা কমবেশি যাই হোক এবারে নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসবে এটা বলাই যায়।
বিগত ১৫-১৬ বছর দলটি নেতাকর্মীদের ওপর যে দমন-পীড়ন ও জুলুম হয়েছে এবং খালেদা জিয়াকে যেভাবে হেনস্তা করা হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে দলটির প্রতি একধরনের দরদ তৈরি হয়েছে, এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, রাজনীতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তারেক রহমান প্রবাসে থেকেও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ভরসার মূল প্রতীক হয়ে উঠেছেন। দেশ পুনর্গঠনে এখন পর্যন্ত রাজনীতিকদের মধ্যে তারেক রহমানেরই সুনির্দিষ্ট বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, কর্মসংস্থান সবক্ষেত্রে তার সুস্পষ্ট কর্মসূচি আছে, যা মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করছে। এরকম একটা জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন, শিক্ষা-চিকিৎসাসহ ভেঙে পড়া বিভিন্ন সেক্টরের মেরামত ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তারেক রহমান এবং বিএনপিকে এক সরলরেখায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এটিই ঐতিহাসিক বাস্তবতা।
অন্যদিকে যারা দেশকে অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে রেখে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চান তাদেরও আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে গেছে তারেক রহমান। তারা তারেক রহমানকে নিয়ে নানা ধরনের অপ্রচার চালাচ্ছে। বিএনপিকে শক্তভাবে এসব অপ্রচার মোকাবিলা করতে হবে। পাশাপাশি দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধেও শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। এ ক্ষেত্রে তারেক রহমানের ভূমিকা হতে হবে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। অন্যথায় দলটি থেকে জনগণ মুখ ফিরিয়ে নেবে। যেমন নিয়েছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার থেকে। তবে আশার কথা, এদেশের জনগণ ভোটাধিকার চায়, নানা চক্রান্তের পরও ভোট হবে, দেশ পুনর্গঠনের পথে এগিয়ে যাবে, ষড়যন্ত্রকারীরা পিছু হটবেই। দেশের জনগণ তারেক রহমানের জন্য অপেক্ষা করছে, বাংলাদেশ অপেক্ষা করছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট