Tuesday 23 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শরিকদের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক
আসন সমঝোতা, নাকি ঐক্যের স্থায়িত্ব পরীক্ষা!

ফারহানা নীলা স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ২৩:০৭

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। ফাইল ছবি

ঢাকা: নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিএনপির সঙ্গে ততই দর কষাকষি বাড়াচ্ছে দীর্ঘদিনের যুগপৎ আন্দোলনের শরিকরা। মাঝে অবশ্য শরিকদের সঙ্গে এ বিষয়ে টানাপোড়েনও সৃষ্টি হয়েছিল বিএনপির। সেই টানাপোড়েন নিরসনে শরিকদের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসেছে বাংলাদেশের বৃহত্তম এই দলটি। গুলশানে দলটির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এ নিয়ে চলছে ধারাবাহিক বৈঠক।

তবে এই বৈঠকে শুধু নির্বাচনি সমঝোতা হচ্ছে না— ভবিষ্যতের ক্ষমতা কাঠামো, রাজনৈতিক আস্থা ও বিরোধী ঐক্যের স্থায়িত্বের পরীক্ষাও হচ্ছে। এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বৈঠকে ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটকে একটি করে আসন ছাড়ের ইঙ্গিতও দিয়েছে বিএনপি। এছাড়া, আরও একটি আসন নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনা বলে দিচ্ছে আপাতত সংকট ব্যবস্থাপনায় নমনীয় অবস্থানে রয়েছে দলটি। এদিকে মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) বৈঠকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে চারটি আসন ছাড় দিয়েছে বিএনপি।

বিজ্ঞাপন

রাজনৈতিক বাস্তবতায় আসন ভাগাভাগি সবসময়ই সংবেদনশীল বিষয়। যুগপৎ আন্দোলনের সময় ‘এক দফা’ দাবিতে ঐক্য থাকলেও নির্বাচন এলে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব সামনে আসে। ১২ দলীয় জোট ও সমমনা জোটের নেতারা কিশোরগঞ্জ-৫, কুষ্টিয়া-২-সহ কয়েকটি আসনে মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবি তুলেছেন। বিএনপির হাইকমান্ড বিষয়গুলো ইতিবাচকভাবে দেখার আশ্বাস দিয়েছে। এটি মিত্রদের জন্য স্বস্তির হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কতটা ভারসাম্য ফেরাবে— সেটিই এখন মূল প্রশ্ন।

জানা গেছে, সম্প্রতি রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও ১২ দলীয় জোটের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি। বৈঠকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু অংশ নেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি এখান দুইস্তরের কৌশল অনুসরণ করছে। প্রথমত, সীমিত আসন ছাড় দিয়ে আন্দোলনের মিত্রদের মনোবল ধরে রাখতে চায়। দ্বিতীয়ত, যাদের সরাসরি মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব নয়, তাদের জন্য ভবিষ্যৎ ‘জাতীয় সরকার’ ও সংসদের ‘উচ্চকক্ষের প্রতিশ্রুতি’ দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে চায়। এতে স্বল্পমেয়াদে ‘ঐক্য’ বজায় থাকলেও দীর্ঘমেয়াদে প্রত্যাশা পূরণ না হলে অস্বস্তি বাড়তে পারে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. রমিত আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপি বুঝতে পেরেছে যে, শুধু বড় দল হওয়াই যথেষ্ট নয়, নির্বাচনি লড়াইয়ে নৈতিক ও রাজনৈতিক বৈধতার জন্য শরিকদের সন্তুষ্ট রাখা জরুরি। তবে কম আসন ছাড় ‘প্রতীকী’ বার্তা দিলেও প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির ফাঁক তৈরি হতে পারে। জাতীয় সরকার ও উচ্চকক্ষের প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিকভাবে আকর্ষণীয়, কিন্তু তা বাস্তবায়নের পথ কতটা স্পষ্ট—সেটাই আসল।’

রমিত আজাদের মতে, বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো, নিজেদের শক্ত ঘাঁটি ধরে রেখে শরিকদের জন্য জায়গা তৈরি করা। অতীতে দেখা গেছে, সমঝোতার অভাবে ছোট দলগুলো কোণঠাসা বোধ করলে মাঠপর্যায়ে ঐক্যের প্রভাব দুর্বল হয়ে দেখা দেয়। তাই এবার আসন ভাগাভাগির পাশাপাশি প্রচার, সরকার গঠনের রূপরেখা ও ক্ষমতা ভাগাভাগির স্পষ্টতা জরুরি।

এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি চেয়াপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুকের মন্তব্যও তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনের শক্তি ছিল ঐক্যে। বিএনপি কখনোই মিত্রদের অবমূল্যায়ন করতে চায় না। আসন ভাগাভাগি নিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে, তা দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বৃহত্তর লক্ষ্যের অংশ। সবাইকে সঙ্গে নিয়েই জাতীয় সরকার গঠনের পথে এগোতে চায় বিএনপি।’

ফারুকের বক্তব্যে স্পষ্ট—দলটি সমঝোতাকে কেবল নির্বাচনি হিসাব হিসেবে দেখছে না; বরং এটিকে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’র রাজনৈতিক ন্যারেটিভের সঙ্গে যুক্ত করছে। তবে মাঠের রাজনীতি বলছে, প্রতীক ও প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি দৃশ্যমান সিদ্ধান্তই শরিকদের আস্থা জোরদার করবে।

এদিকে ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা ও সমমনা জোটের সমন্বয়ক ফরিদুজ্জামান ফরহাদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, আলোচনা আপাতত ইতিবাচক। তারা দীর্ঘদিনের মিত্র হিসেবে ‘সর্বোচ্চ মূল্যায়নের’ আশ্বাস পেয়েছেন। কিন্তু সমমনা জোট যেখানে নয়টি আসন চেয়েছে, সেখানে এক বা দুই আসনের ইঙ্গিত তাদের প্রত্যাশা পূরণ করবে কি না, সেটি এখনো অনিশ্চিত।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, জাতীয় সরকার গঠনের দাবি। যুগপৎ আন্দোলনের শরিকরা চায়, ক্ষমতায় গেলে সরকারে যেন সবার প্রতিনিধিত্ব থাকে। এটি বিএনপির জন্য দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ। একদিকে বহুদলীয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, অন্যদিকে শাসনব্যবস্থার কার্যকারিতা বজায় রাখা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যদি বিএনপি একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ দিতে পারে—কে কোন ভূমিকায় থাকবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাঠামো কেমন হবে, তাহলে এই দাবি ঐক্যকে আরও দৃঢ় করতে পারে।

সব মিলিয়ে, আসন ভাগাভাগি নিয়ে শুরু হওয়া এই বৈঠকগুলো কেবল সংখ্যার সমীকরণ নয়; এটি বিরোধী রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথনির্দেশও বটে। বিএনপি যদি সীমিত ছাড়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্মানজনক রাজনৈতিক অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে যুগপৎ ঐক্য টেকসই হতে পারে। অন্যথায়, এই ঐক্য ভবিষ্যতে নতুন টানাপোড়েনে পড়তে পারে।

এখন নজর থাকবে পরবর্তী বৈঠকগুলোতে জোটের সঙ্গে আলোচনায় বিএনপি কতটা উদারতা দেখায়। তাদের বৈঠক পরবর্তী সিদ্ধান্তই বলে দেবে, আসন সমঝোতার এই রাজনীতি শেষ পর্যন্ত ঐক্যকে শক্তিশালী করবে, নাকি কেবল সময়ক্ষেপণের কৌশল হিসেবেই রয়ে যাবে।

বিজ্ঞাপন

আরো

ফারহানা নীলা - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর