রাজশাহীতে নৌকার ভরসা ‘ভাসমান ভোট’, ধানের শীষের ‘নীরব ভোট’
২৯ জুলাই ২০১৮ ২৩:১২
।। নৃপেন রায়, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
রাজশাহী থেকে: প্রচারণা শেষ, এখন জনগণের রায় দেওয়ার পালা। সোমবার (৩০ জুলাই) সকাল থেকে সেই রায় দেওয়ার অপেক্ষায় এখন রাজশাহীবাসী। মেয়র পদে এই নগরীতে পাঁচ প্রার্থী থাকলেও নগরবাসী বলছেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মূলত বর্তমান মেয়র বিএনপির মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের মধ্যে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোট ফ্যাক্টর বিবেচনায় নৌকার প্রার্থী লিটন আশায় আছেন ‘ভাসমান ভোটার’দের রায়ের অপেক্ষায়; আর ধানের শীষের বুলবুলের ভরসা ‘নীরব ভোটারে’।
সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি সোমবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে রাজশাহী সিটি করপোরেশনেও (রাসিক)। নির্বাচন কমিশন বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। নির্বাচনকে ঘিরে শনিবার (২৮ জুলাই) থেকেই মাঠে নেমেছ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা থেমেছে শুক্রবার মধ্যরাতে। আর রোববার দুপুর থেকে থেকে প্রতিটি কেন্দ্রে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপারসহ নির্বাচনী সামগ্রী পৌঁছানো হয়।
নগরবাসী বলছেন, নির্বাচনের আগে রাজশাহী সিটির এ নির্বাচন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের জন্যই এসিড টেস্ট। নির্বাচনে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন হারলে হারলে হারবে সরকার; একইসঙ্গে সারাদেশের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নয়নের দৌড়ে পিছিয়ে পড়বে রাজশাহী নগরী। আর মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল হারলে জাতীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা বিএনপি যে আরও নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়বে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই কারো।
আবার জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজশাহীর ভোট নির্বাচন কমিশনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। বিরোধী পক্ষের অভিযোগ নাকচ করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দাবি করে আসা নির্বাচন কমিশনকে ভোটের দিন আসল পরীক্ষা দিতে হবে দেশবাসী ও রাজশাহীর ভোটারদের কাছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে ঘিরে নগরীতে একদিকে যেমন উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে, অন্যদিকে কাজ করছে অজানা আশঙ্কাও।
রাসিকে এবার মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন পাঁচ জন। তারা হলেন- আওয়ামী লীগের এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন (নৌকা), বিএনপির মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল (ধানের শীষ), স্বতন্ত্র প্রার্থী মুরাদ মোর্শেদ (হাতী), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা শফিকুল ইসলাম (হাতপাখা) ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (মতিন) হাবিবুর রহমান (কাঁঠাল)।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারের নির্বাচনে দলীয় ভোটারের বাইরে নতুন ও ভাসমান ভোটারারা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে। এছাড়াও প্রায় বস্তিবাসীর ২০ হাজার, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২৯ হাজার, নতুন ৩০ হাজার ও উর্দু ভাষাভাষী (বিহারি) প্রায় ১৫ হাজার ভোট নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে।
জানা গেছে, ২০১৩ সালের তুলনায় এবার নতুন ভোট বেড়েছে প্রায় ৩০ হাজার। এসব ভোট অধিকাংশই নৌকা মার্কায় যাবে বলে নগরবাসী মনে করছেন। সংখ্যালঘু ২৯ হাজার ভোটাররা রাজশাহী সিটির জয়-পরাজয়ে ভূমিকা রাখবে বলেও মনে করছেন স্থানীয়রা। আবার নগরীর উর্দু ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ বরাবরই বিএনপি পেয়ে আসছে। এবারের নির্বাচনে এই ভোট পাওয়ার জন্য দুই প্রার্থীই মরিয়া। দু’দলের শীর্ষ নেতারাই বিহারী ক্যাম্পে তাদের ভোট পেতে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন।
এদিকে, নগরীতে বস্তিবাসীর ভোট রয়েছে ২০ হাজার। এর আগের নির্বাচনগুলোতে এই ভোট অর্থের বিনিময়ে নিজের পক্ষে টানতে দেখা গেছে। তবে এবার ভোটাররা মনে করছেন, সেই সময় আর নেই। এখন তাদের আয় রোজগার ভালো। তাদের ছেলেমেয়েরাও লেখাপড়া শিখছে। তাদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা কমেছে। তাই বিশাল এই ভোট ব্যাংক সম্পর্কে কারোই স্পষ্ট ধারণা নেই।
রাজশাহীতে হেফাজতে ইসলামের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ১৫-২০টি মাদরাসা। ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে এসব মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীরা সরাসরি বিএনপির মেয়র প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। এবারের নির্বাচনে তাদের সক্রিয় কোনো অবস্থানে দেখা যায়নি। তবে তাদের অবস্থান নিয়ে সতর্ক দৃষ্টি থাকবে প্রার্থীদের।
রাসিক নির্বাচনে নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীকের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর জয়ের সম্ভাবনা নিয়ে কথা হয় বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থী লিটন নতুন করে রাজশাহীর দায়িত্ব পেতে ভরসা করছেন নতুন অর্থাৎ ‘ভাসমান ভোটার’দের ওপর। অন্যদিকে, স্বচ্ছ নির্বাচন নিয়ে বরাবরই শঙ্কা জানিয়ে আসা বিএনপি প্রার্থী বুলবুল মনে করছেন, জনগণ তার পক্ষে সরব অবস্থান না নিলেও ভোটকেন্দ্রে রায় দেবেন তার পক্ষেই।
রাসিক নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং অফিসার আতিয়ার রহমান জানান, নির্বাচনে মোট প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা ২১৭ জন। এর মধ্যে মেয়র পদে প্রার্থী রয়েছেন পাঁচ জন। আর ৩০টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে আছেন ১৬০ জন। এছাড়া ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর পদের প্রার্থী ৫২ জন। মোট ভোটার সংখ্যা তিন লাখ ১৮ হাজার ১৩৮ জন। মোট ভোটারের মধ্যে এক লাখ ৬২ হাজার ৫৩ জন নারী ভোটার এবং পুরুষ ভোটার এক লাখ ৫৬ হাজার ৮৫। রাজশাহীতে এবার মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ১৩৮টি এবং বুথের সংখ্যা রয়েছে ১ হাজার ২০টি। প্রতিটি কেন্দ্রে একজন করে প্রিজাইডিং অফিসার দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া প্রতিটি বুথে একজন করে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং দুইজন করে পোলিং অফিসার দায়িত্ব পালন করবেন। এবার নগরীর দুইটি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেওয়া হবে। কেন্দ্র দুইটি রয়েছে রাজশাহীর বিবি হিন্দু একাডেমিতে।
ভোটের নিরাপত্তায় পুরো নগরীকে ছয় সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি সেক্টর ভাগ করা হয়েছে আরও দুটি উপসেক্টরে। প্রতি সেক্টরে একজন করে পুলিশ সুপার এবং উপসেক্টরে একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দায়িত্ব পালন করবেন। কেন্দ্রের বাইরেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি থাকবে। প্রতি তিন কেন্দ্রে পরিদর্শকের নেতৃত্বে পুলিশের ৯ সদস্যের ভ্রাম্যমাণ দল থাকবে। প্রতি ছয় কেন্দ্রের জন্য এএসপির নেতৃত্বে থাকবে আলাদা স্ট্রাইকিং রিজার্ভ ফোর্স। উপপরিদর্শকের নেতৃত্বে প্রতি তিন কেন্দ্রে সাতজনের একটি করে দাঙ্গা দমন দল দায়িত্ব পালন করবে। বিশেষ স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে রিজার্ভে থাকবে পুলিশ ও আনসারের ১২টি দল। প্রতিটি দলে সদস্য থাকবেন ১৬ জন করে। পুলিশ এছাড়া র্যাব, বিজিবি ও আনসার সদস্য টহল দেবে নগরজুড়ে। এ ছাড়া, ৩০ ওয়ার্ডে ৩০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে মোবাইল কোর্ট থাকছে। ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে একজন করে থাকছেন বিচারিক হাকিম।
নগরীতে বিভিন্ন যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে শনিবার দিবাগত রাত থেকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে সব ধরনের মোটরসাইকেল চলাচল। ভোটের আগের রাত ১২টা থেকে পরদিন রাত ১২টা পর্যন্ত চলতে পারবে না ট্যাক্সি ক্যাব, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, বাস, ট্রাক, টেম্পো, বেবিট্যাক্সি, অটোরিক্সা, ইজিবাইকসহ স্থানীয়ভাবে পরিচিত অন্যান্য যন্ত্রচালিত যানবাহন। বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রও বহন ও প্রদশন নিষিদ্ধ করেছে জেলা প্রশাসন।
আরও পড়ুন-
বরিশাল শান্ত, ভয় তবুও পুলিশে
সিলেটে নির্বাচনী সামগ্রী বিতরণে বিলম্ব, ক্ষোভ বিএনপির
মর্যাদার লড়াই লিটনের, হারানোর কিছু নেই বুলবুলের
পূণ্যভূমিতে উড়বে নৌকার বিজয় পতাকা: কামরান
তিন সিটিতে জয়ী হবে নৌকা: জরিপ
প্রশাসন ও পুলিশ বিবেকশূন্য অনাচারে লিপ্ত
সিটি নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের রিহার্সেল
বিএনপির অভিযোগ, ইসি বলছে ভিত্তিহীন
সারাবাংলা/এনআর/টিআর