‘ইউরোপ বলতে কিছু নাই, কেবল ধাপে ধাপে বিক্রি হইছি’
৩১ জুলাই ২০১৮ ০৯:২১
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা : ‘দালালরা বলছে ইউরোপ নিয়ে যাবে। কিন্তু ইউরোপ বলতে কিছু নাই, কেবল ধাপে ধাপে বিক্রি হইছি আমরা’ বলছিলেন বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের মো. ইলিয়াস হাওলাদার। আর শারীরিকভাবে কিছুটা প্রতিবন্ধী মনির হক যখন ‘২২ ঘণ্টা নৌকার মধ্যে থেকে কেমন লাগে সেটা কেউ বুঝবেন না’ বলে সশব্দে কেঁদে ওঠেন তখন পুরো হলরুম নিস্তব্ধ হয়ে যায়, আড়ালে কেউ চোখের কোন মোছেন।
এমনি এক পরিবেশের সৃষ্টি হয় ব্র্যাক সেন্টারের ইনে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম আয়োজিত ‘মানবপাচার ও অনিয়মিত অভিবাসন’ শীর্ষক এক মিডিয়া ডায়ালগ অনুষ্ঠানে।
সোমবার (৩০ জুলাই) মানব পাচার প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে ইউরোপিয়ান ইউনিয়েনের অর্থায়নে চলমান প্রত্যাশা প্রকল্পের আওতায় ব্র্যাক ও জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএম যৌভভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
সেখানে পাচার হয়ে দেশে ফেরত ইলিয়াস হাওলাদার, মনির হক, অন্তর আলী দেওয়ান তাদের দুর্বিসহ দিনের বর্ণনা দেন।
বর্ণনা করেন, কীভাবে তাদের নির্যাতন করা হয়েছে, কীভাবে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে দালাল চক্র। ইউরোপের লোভ দেখিয়ে, সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে তাদেরকে কেবল সর্বস্বান্ত করাই হয়নি, শরীরে এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন নির্যাতনের চিহ্ন।
সাভারের বিরুলিয়া থানার অন্তর আলী দেওয়ান ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ইউরোপের গ্রিসে যাওয়ার উদ্দেশে বাড়ি যান। কিন্তু তাকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় ইরাক, সেখান থেকে তুর্কি, সেখান থেকে গ্রিস। এই পুরো সময় কখনো পায়ে হেঁটে, পাল তোলা নৌকায় করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আবার কখনওবা ছোট্ট একটা কনটেইনারে চলেছেন অন্তর আলী দেওয়ান।
অন্তর আলী দেওয়ান বলেন, ‘দালালের মাধ্যমে ইরাকে গিয়েছিলাম টুরিস্ট ভিসা নিয়ে। সেখানে তো একমাসের বেশি থাকা সম্ভব ছিল না, দালাল বলছিল-কোনো সমস্যা হবে না, কত মানুষ নিয়েছি, ইরাক থেকে গ্রিসে যাওয়া ওয়ান-টুর ব্যাপার।’
‘কিন্তু যাওয়ার পথটা ছিল ভয়াবহ। প্রথমে একদিন দুবাই থেকে ইরাকের উদ্দেশে রওনা হলাম, সেখানে আটঘণ্টা থাকার পর দালাল এসে নিয়ে গেল। সাত থেকে আট ঘণ্টা লাগল নাজাব থেকে বাগদাদ যেতে। বাগদাদ থেকে একরাত থেকে কারকুতে নিয়ে গেল, সেখানে ছিলাম চারদিন। রাতের বেলায় কুর্দিস্তান নিয়ে যায়-সেখানে একটা কারখানায় লেবারের কাজ করি কয়েকদিন। পরে সেখান থেকে তুর্কির উদ্দেশে আবার রওনা হয়, রাতের বেলায় পাহাড়ে পাহাড়ে হাঁটা। সে কী পাহাড়, হাঁটতে হাঁটতে হাত পায়ের চামড়া উঠে গেছে, হাত-পা কেটে রক্ত বের হয়ে সে কী অবস্থা, এখনও হাতে পায়ে কাটা দাগ আছে-বলে হাতের কাটা দেখান অন্তর আলী, দেখান হাতুড়ির আঘাতে কালো হয়ে যাওয়া নখ।
অন্তর আলী বলেন, ‘তারপর এক গাড়িতে করে সাত ঘণ্টা জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে গেল, সেখানে ছিলাম তিনদিন। এই তিনদিন দিনে-রাতে একবেলা খাওয়া পেতাম,সেটাও ছিল শুকনা একটা অথবা দুইটা রুটি। ভয়ে একেকজন কুঁকড়ে যেতাম, কিন্তু কারও কিছু করার ছিল না। সেখান থেকেই গ্রিসের পথে রওনা হলাম। রাতের বেলায় নৌকায় করে নদী পার হয়ে আবার আরেক জঙ্গল। সেই নদী পার হতে নেয় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। যে নৌকায় দশ থেকে পনের জন যে ধরবে, সেখানে ওঠালো ৩০ জন। সেখানে বাংলাদেশিসহ অন্য দেশের লোকেরা ছিলও।
অন্তর আলী বলেন, ‘ইরাক পর্যন্ত যেতে নিয়েছে চার লাখ ৪৮ হাজার টাকা, একেকটা জায়গা পার করেছে আর টাকা নিয়েছে। এভাবে মোট ১০ লাখ টাকা দিতে হয়েছে দালালকে। ধাপে ধাপে কত জায়গায় যে টাকা দিয়েছি।’
অন্তর আলী যে দলে ছিলেন সেখানে মোট ১৫ জনের ‘সবাই ছিলাম বাংলাদেশি’ জানিয়ে অন্তর আলী বলেন, ‘গ্রিসে যাওয়ার পর আমাদের পৃথক পৃথক রুমে রাখা হয়েছিল। টাকা চাওয়াতে দিতে পেরেছিলাম বলে মারধর করেনি। কিন্তু যারা দিতে পারেনি তাদেরকে মেরেছে। তারাও কিন্তু বাঙালি। ওই দেশের লোকের সঙ্গে মিলে তাারা এসব কাজ করে, কিন্তু নাটের গুরুই হইল বাঙালি।’
দালালেরা টাকা দাবি করলে টাকা দেওয়ার মতো ছিল না। এরমধ্যে তিনজনকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আহত করে ফেলাইলো। পাশের রুম থেকে সব শুনতাম আর ভয়ে একে জন আরেকজনকে জড়ায়ে ধরতাম। আরেকজন একেবারে মরেই গেল। যদি টাকা দিতে না পারতাম তাহলে আমাদের অবস্থাও তাদের মতো হইত। সেসব দিনের স্মৃতি আজও ভুলিনি, চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় মন্তব্য করে অন্তর আলী বলেন, গ্রিসে যাওয়ার পর ছিলাম ছয়মাসের মতো।
ইতোমধ্যেই ইউরোপে পুরো চেকইন পরলো যে কাগজপত্র ছাড়া যেসব বাঙালি আছে তাদের ধরা হবে। এর আগে আমাদের দেওয়া কার্ড রিনিউ করতে গেলে ধরা পরলাম। সেই অফিস আমারে আটকাইয়া দিল, পুলিশে দিল। এরপর থানায় ১৫ দিন আর জেলে ছিলেন দুইমাস ছিলেন অন্তর আলী। বলেন, জেলে গিয়ে জানতে পারেন এরপরও যদি সেখানে থাকতে চান, তাহলে জেল হবে এক বছরের। তারপরও কোনা নিশ্চয়তা না থাকাতে গত বছর তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন।
অন্তর আলী বলেন, ‘জমি-জমা বিক্রি করছি, তিনটা গরু বিক্রি করছি, স্ত্রীর গয়না ছিল সেগুলোও বিক্রি করছি। সব বিক্রি করে টাকা দিয়েছি। এখনও আত্মীয়রা প্রায় ছয় লাখের মতো টাকা পায়। দিনমজুরের কাজ করে কোনও রকমে স্ত্রী আর তিন সন্তান নিয়ে বেঁচে আছি।’
আবার ইলিয়াস হাওলাদারের যখন নিজের অভিজ্ঞতা বলছিলেন, তখন পুরো হলরুম চুপ। তিনি বলেন আর একেক জন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
২০১১ সালের জুনে আবুধাবি গিয়ে দশমাস মরুভূমিতে ৫০ দিরহাম অর্থাৎ বাংলাদেশের ১১০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন ইলিয়াস। কিন্তু এই বেতন নিয়ে যখন দালালের সঙ্গে বচসা হয় তখনই দুর্ভাগ্য নেমে আসে তার জীবনে। সেই দালাল অন্য কোথাও নেওয়ার কথা বলে গাড়িতে তোলে, প্রথমে শারজাহ, সেখান থেকে ওমান।
ইলিয়াস বলেন, ‘যারা আমাদেরকে নেওয়া আসা করে তারা ছিল পাকিস্তানি। তারা জানায়, ইউরোপ নিয়ে যাচ্ছি। অথচ, ‘ইউরোপ বলতে কিছু নেই, ধাপে ধাপে বিক্রি হইছি, আর কিছু না।’
কিন্তু ইউরোপ যেতে না চাইলেও তারা এমন করে রাখবে যে, পালানোর কোনো উপায় থাকে না। স্পিড বোটে সেই আধাঘণ্টা হয় পরের দিন। সেখান থেকে ইরান, সেখানেও এক জঙ্গলেও ছিলাম সাতদিন। তারপর নিয়ে যাওয়া হয় এক দালালের বাসায়। ওখানেই মূলত শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন।
শারীরিক নির্যাতন কেন জানতে চাইলে ইলিয়াস বলেন, ‘তারা নাকি আমাদেরকে দশ লাখ টাকা দিয়ে আনছে। কথা বলার কোনো সুযোগ নেই, বাড়িতে ফোন দিয়ে টাকার কথা বলো। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যারা অত্যাচার করে তারাও বাঙালি। সেখানে এক ঘরে টাকা দিলে আরেক ঘরে নিয়ে যায়। এই করে করে আমার ৭ লাখ ১০ হাজার টাকা দেওয়া হইছে।’
‘সেখানে টাকা দিতে না পারলে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। আমাদের মারতে থাকা অবস্থায় বাড়িতে ভিডিও ফোন দেয়। বাবা-মা যখন শুনবে সন্তান চিৎকার দিতেছে তখন তারা কী করবে? জায়গা-জমি, গরু-ছাগল, গয়না যার যা আছে তখন সে তাই বিক্রি করবে, বিক্রি করে টাকা পাঠাবে সন্তানকে বাঁচানোর জন্য।’
‘পায়ের নখ তুলে ফেলছে, আয়রন দিয়ে ছ্যাকা দিত-মারের কোনও শেষ নাই। মাইর যে কত প্রকার সেটা বলে শেষ করা যাবে না। টাকা দেয়া আর ওরা খালি বিক্রি করে। নির্যাতন সইতে না পেরে একদিন ভোররাতে পালালে ধরা পরেন পুলিশে কাছে। কোর্টে থেকে অর্ডার দেয় পাকিস্তান বর্ডারে ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলে, কারণ ইরান থেকে বাংলাদেশে আসার নাকি সরাসরি রাস্তা নাই। পরে জেলে ছিলাম তিনমাসের মতো। সবমিলিয়ে ২৭ জনের মতো ছিলাম ইরানের জেলে।’
জেলের অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ মন্তব্য করে ইলিয়াস বলেন, ‘আমি ইরানের জেলে ঢুকেছি ১৯ রমজান, তখন থেকে শুনছিলাম, তেহরান থেকে রাষ্ট্রদূত আসতেছে। শুরুতে ছিলাম ২৭ জন, রাষ্ট্রদূত আসতে আসতে ৩০০ জনের ওপরে মতো হলাম। সেই ১৯ রোজা থেকে শুনতে থাকা তারা এলেন কোরবানি ঈদের আগে।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে ইলিয়াস বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে জেলে একজন ভারতীয় ঢুকেছে, চার থেকে পাঁচদিনের মাথায় সে চলে গেল, তাকে এসে নিয়ে গেল। অথচ আমরা মাসের পর মাস জেলের পইরা রইছি, কারন, তারা আমাদের কোনো মূল্যায়ন করে নাই।’
তারপর দূতাবাস থেকে বলল, তোমরা আসছ নিজের তাগিদে, যাবাও নিজের তাগিদে। বাঁচতে হলে নিজ খরচে যাইতে পারলে যাইতে পারবা, নয়ত পারবা না। পরে জিয়াউর রহমান নামের একজনের সঙ্গে পরিচয় করায়ে দেয়, কীভাবে টাকা দিতে হবে সেসব বুঝবে। সিলেটের বাড়িতে গিয়ে টাকা দিয়ে আসতে হবে। এখানে সবচেয়ে বড় কথা, যারা দালাল তারাও সিলেটি, আবার যারা দূতাবাসের লোক তারাও সিলেটি। তারপর
বাড়িতে যে ঘর ছিল সে ঘর বিক্রি কইরা জেলে বইসা ৬৫ হাজার টাকা দিয়া তারপর বাংলাদেশে আসছি ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে। সব মিলিয়ে দশ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়।’
নিজের দুর্ভাগ্যের কথা বলতে গিয়ে ইলিয়াস বলেন, ‘ওখানে যাওয়ার পর কোম্পানি বলে, তোমাদেরকে টাকা দিয়া আনছি। অথচ আমরা যাওয়ার আগে দুই থেকে চার লাখ দিয়া গেছি। অথচ কোম্পানি বলে টাকা দিয়ে আনছি, তোদের সঙ্গে কী ব্যবহার করব-তাই এদেশ থেকে যাওয়ার আগে এগুলো নিশ্চিত করতে হবে সবাইকে, নয়ত তার মতোই সব বিক্রি করে হয়ত প্রাণটুকু হাতে নিয়ে ফেরত আসতে হবে’ বলেন তিনি।
আর মনির হক কান্নার তোড়ে কথাই বলতে পারলেন না। ধরা গলায় কেবল বললেন, ‘আমি কোনও কথা বলতে পারব না। শুধু বলি, কারও যেন এ ভাগ্য না হয়।’
সারাবাংলা/জেএ/একে