উবার দুর্ঘটনায় ইনস্যুরেন্স : আছে আশ্বাস নেই প্রয়োগ
২ আগস্ট ২০১৮ ০৮:২৬
।। মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর।।
ঢাকা: গত ৭ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) এমডি কোর্সের আবাসিক চিকিৎসক ড. সাকিব-আল-নাহিয়ান তার কলেজে যাওয়ার জন্য উবারের মাধ্যমে একটি বাইক ডেকে নেন। পথে দুর্ঘটনায় তার কশেরুকার কয়েকটি হাড় ভেঙে যায়। এই দুর্ঘটনার কারণে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে সময় হারাতে হচ্ছে, চিকিৎসার পেছেনেও লাখ টাকাও খরচ করতে হচ্ছে ডা. সাকিবকে। অথচ দুর্ঘটনার কারণে উবারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা ছিল তার। ডা. সাকিব জানান, দুর্ঘটনার কয়েকদিন পর উবারের পক্ষ থেকে একজন ফোন করে কথা বললেও পরে আর কেউ যোগাযোগ করেনি তার সঙ্গে।
২০১০ সালে যখন যাত্রা শুরু করে, তখনই প্রশ্ন ওঠে— উবারের আওতায় থাকা গাড়িতে দুর্ঘটনা ঘটলে তার তায় কে নেবে? উবার নিজে গাড়ির মালিক না হওয়ায় এই প্রশ্ন আরও প্রকট হয়। উবার পরিচিত ও জনপ্রিয় হতে থাকলে এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা হয়। অবশেষে রাইডার ও চালকদের জন্য ক্ষতিপূরণের বিধান আনে উবার। বাংলাদেশেও উবার এমন দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দেবে বলে গত ৪ জুন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় বাংলাদেশের উবারের মুখপাত্র বেঞ্চমার্ক পিআর। তবে এ ঘোষণার পরও ইনস্যুরেন্স দেওয়ার বিষয়ে কোনো ইতিবাচক উদাহরণ তৈরি করতে পারেনি রাইড শেয়ারিংয়ের এই সেবা।
ডা. সাকিব সারাবাংলা’কে বলেন, গত ৭ জুলাই সকাল ৮টা ১৮ মিনিটে একটি উবার মোটরবাইকে (ঢাকা মেট্রো হ: ১১-৩৭৭৭) চড়ে ঝিগাতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যাচ্ছিলাম। রাস্তা খালি ছিল। ধানমন্ডির ২ নম্বর রোড থেকে ১ নম্বর রোডে যাওয়ার জন্য আমার ড্রাইভার ডানে মোড় নেয়। ওই সময় দূর থেকে একটা কালো রঙের নোয়াহ মাইক্রোবাস আসছিল। চালককে একাধিকবার ধীরে চালানোর অনুরোধ করলেও তিনি শোনেননি। এক পর্যায়ে মাইক্রোবাসটি আমার বাইককে আঘাত করে। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই।
এই দুর্ঘটনায় ডা. সাকিবের মেরুদণ্ডের কশেরুকার কয়েকটি হাড় ভেঙে গিয়েছে। হাড়ের মাঝের ডিস্ক প্লেট বের হয়ে এসেছে। ফলে তার কশেরুকার স্নায়ুগুলো কর্মক্ষমতা হারিয়েছে। এক মাস পরও ড. সাকিবকে বিছানায় শুয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। ডা. সাকিবের চিকিৎসক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান জানান, এরকম কাটাতে হবে ২৪ সপ্তাহ।
ডা. সাকিব জানান, দুর্ঘটনার পর অচেতন অবস্থায় একজন পুলিশ সদস্য তাকে উদ্ধার করে প্রথমে ল্যাব এইডে, পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান। সেখানে দীর্ঘ সময়ের জন্য বেড না পাওয়ায় তাকে বাড়িতেই বেড রেস্টে রাখা হয়। এ বিষয়ে ৭ জুলাই ধানমন্ডি থানায় পুলিশের উপসহকারী পরিদর্শক (এএসআই) শওকত আলী একটি সাধারণ ডায়েরি দায়ের করেন (ডায়েরি নং-৩৮০)।
দুর্ঘটনার কিছুদিন পরে উবারের একজন কর্মকর্তা 08006640804 নাম্বার থেকে ফোন করে ডা. সাকিবের কাছে ঘটনার বিবরণ জানতে চান। সব শুনে তিনি জানান, তিনি আবার ফোন করবে। ড. সাকিব বলেন, যিনি ফোন করেছিলেন তিনি সম্পূর্ণ ইংরেজি ভাষায় কথা বলেছেন। এরপর এখন পর্যন্ত (৩১ জুলাই) উবারের পক্ষ থেকে আর কেউ যোগাযোগ করেনি। এমনকি ওই নাম্বারে ফোন করে কারও পর্যন্ত পৌঁছানো যায়নি।
ডা. সাকিব আরও বলেন, এই দুর্ঘটনার ফলে আমার চলতি কোর্স ব্যাহত হচ্ছে। এতে আমার প্রায় ছয় মাসের শিক্ষাবর্ষ পিছিয়ে যাবে। এ ছাড়াও চিকিৎসা ব্যয় এখন পর্যন্ত লাখ টাকা ছাড়িয়েছে এবং দীর্ঘকালীন কিছু ক্ষতির আশঙ্কাও দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে উবারের কোনো স্থায়ী মুখপাত্র না থাকায় সারাবাংলা বাংলাদেশে উবারের মুখপাত্র বেঞ্চমার্ক পিআরের কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘দুর্ঘটনা যেহেতু হয়েছে, উবার ক্ষতিপূরণ অবশ্যই দেবে।’ তবে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি।
‘উবার শিগগিরই ইনস্যুরেন্স দাবি করার পদ্ধতি সম্পর্কে জানাবে।’,— বলেন বেঞ্চমার্ক পিআরের ওই কর্মকর্তা। এছাড়াও তিনি উবারের পূর্ব-ভারত ও বাংলাদেশ অঞ্চলের প্রধান সংযোগ কর্মকর্তা বৃন্দা রায়ের সঙ্গে ইমেইলে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
এর আগে উবারে যাত্রী হয়রানির বিষয় নিয়ে সারাবাংলা বেঞ্চমার্ক পিআরের মাধ্যমে উবারের সঙ্গে ইমেইলে যোগাযোগ করে। তখনও উবার অধিকাংশ প্রশ্ন এড়িয়ে যায়। সম্প্রতি চ্যানেল নাইনের সাংবাদিকে আফজাল মোহাম্মদও একটি প্রতিবেদনের কাজে উবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালান। আফজাল বলেন, উবার মেইলের কোনো জবাব দেয়নি।
উবার দুর্ঘটনায় যাত্রীর ইনস্যুরেন্স দেওয়ার বিষয়ে সারাবাংলা’কে আইনজীবী ব্যারিস্টার অনীক আর হক বলেন, ‘প্রথমত, সারাবিশ্বে এ ধরনের রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান আছে। দ্বিতীয়ত, উবার নির্ধারণ করার কেউ নয় যে কোনো দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ কত হবে। কারণ আইন অনুযায়ী একজন বয়স্ক ব্যক্তি ও একজন তরুণের ক্ষতিপূরণ এক হবে না। তৃতীয়ত, তারা যদি ইনস্যুরেন্স দেওয়ার আশ্বাস দেয় কিন্তু দুর্ঘটনার পরে তা না দেয়, তবে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।’
‘আমাদের দেশে উবার, পাঠাওয়ের মতো সার্ভিসগুলো চলাচলে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। তবে তার মানে এই নয় যে তারা আইনের ঊর্ধ্বে। তাদেরকেও নিয়মের আওতায় আনতে হবে।’,— বলেন এই আইনজীবী। অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সার্ভিসগুলোর জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে এগুলোর সমস্যাও বাড়ছে, এগুলোর সমাধান না করা হলে এই রাইডগুলোই একসময় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশে উবারের মুখপাত্র না থাকার বিষয়ে ব্যারিস্টার অনীক বলেন, যখনই প্রতিষ্ঠান সার্ভিস ওরিয়েন্টেড প্রতিষ্ঠান নিয়ে বাজারে আসবে, তাদের গ্রাহকদের কথা শুনতে হবে এবং তাদের সমস্যার সুরাহা করতে হবে। তা না হলে গ্রাহকের সুরক্ষা বিঘ্নিত হয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়মের আওতায় আনতে পারে।
বাংলাদেশে কাজ করা একটি প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা জটিল কেন হবে— জানতে চাইলে বিআরটিএ সচিব মো. শওকত আলী সারাবাংলা’কে বলেন, বিআরটিএ’র পক্ষ থেকে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকার একটি নীতিমালার আওতায় আনতে চাচ্ছে। এই নীতিমালা অনুযায়ী এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ঢাকায় অফিস থাকতে হবে। নীতিমালায় আমরা স্পষ্ট দু’টি জিনিস রেখেছি— এক, কোনো যাত্রী যদি বিপদে পড়লে সে যেন তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ কন্ট্রলরুমে (৯৯৯) যোগাযোগ করতে পারে; এবং দুই, রাইড শেয়ারিং অ্যাপ থেকে যেন জীবনের নিরাপত্তা পান।
এক ফাঁকে তিনি বিআরটিএ সচিব এও জানিয়ে রাখেন, ‘আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখেছি, ঢাকাতে উবারের অফিস আছে এবং তারা আমাদের মিটিংয়ে প্রতিনিধি পাঠান।’ তিনি আরও বলেন, আমরা নীতি নির্ধারকের পদ থেকে নেমে সাধারণ মানুষের কাতারে দাঁড়ালে বলতেই হয়, এই আচরণ কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়।
সারাবাংলা/এমএ/এমআই/টিআর