রাস্তা বন্ধ করে ‘রাষ্ট্র মেরামতে’ কিশোররা, শনিবার ফের বিক্ষোভ
২ আগস্ট ২০১৮ ১৭:৫৬
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: আগামী শনিবার সকাল ১১টা থেকে আবারও বিক্ষোভের ঘোষণা দিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর ওয়াসার মোড় ছেড়েছেন নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তবে নগরীর ষোলশহর দুই নম্বর গেইট এলাকায় এখনও অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি যানবাহনে তল্লাশিও চালাচ্ছেন তারা।
বৃহস্পতিবার (০২ আগস্ট) দুপুর ২টার দিকে ওয়াসার মোড় ছেড়ে যান শিক্ষার্থীরা। এরপর লালখান বাজারের ইস্পাহানি মোড় থেকে ওয়াসার দিকে গাড়ি চলাচল কিছুটা স্বাভাবিক হয়। তবে ওয়াসা থেকে আনুমানিক তিন কিলোমিটার দূরে দুই নম্বর গেইট এলাকার দিকে গিয়ে যানবাহনের গতি আবারও শ্লথ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে পুরো নগরজুড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।
নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) মো.আব্দুল ওয়ারিশ খান সারাবাংলাকে বলেন, দুই নম্বর গেইটে এই মুহুর্তে দুই হাজারেরও বেশি ছাত্রছাত্রী আছে। যানবাহন স্বাভাবিকভাবে চলতে পারছে না। কিছু কিছু যানবাহন আসছে। সেগুলোর লাইসেন্স চেক করছেন তারা। আশপাশে জ্যাম হয়ে গেছে।
শনিবার ফের বিক্ষোভের ঘোষণা
নগরীর ওয়াসার মোড়ে সকাল ১০টা থেকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে শুরু করেন। তাদের হাতে ছিল বিভিন্ন ধরনের স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড। কারও হাতে ছিল জাতীয় পতাকা। কেউ গায়ে পতাকা জড়িয়ে এসেছেন।
‘শ্রদ্ধেয় জনগণ, উই আর স্যরি, পেইন টুডে গেইন টুমরো’/ ‘রাস্তা বন্ধ, রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে’/‘আপনারা ছেলেকে পাঠিয়ে দিন, মেরে ১০ লক্ষ টাকা পাঠিয়ে দিবো’- এই ধরনের বিভিন্ন স্লোগান নজর কাড়ে উপস্থিত লোকজনের।
সকাল ১১টা থেকে দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করে। শিক্ষার্থীরা দলে দলে ভাগ হয়ে গাড়ি তল্লাশি শুরু করে। চালকের লাইসেন্স না থাকায় আটকে দেওয়া হয় নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার হারুনুর রশিদ হাজারীর গাড়িও। পুলিশ, নৌবাহিনীসহ বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার গাড়িও তল্লাশির মুখে পড়ে। লাইসেন্স না থাকায় প্রাইভেট কারের চালককে গাড়ি থেকে নামিয়ে মাফ চাইতে বাধ্য করার দৃশ্যও দেখা গেছে। যেসব গাড়িতে লাইসেন্স পাওয়া যায়নি সেগুলোর আয়নায় লিখে দেওয়া হয় ‘লাইসেন্স নেই’।
এর মধ্যে একটি বাস ও পুলিশের একটি টহল ভ্যান ভাংচুর হয়। পুলিশ ভ্যান দ্রুতগতিতে চলে যাবার সময় পাথর ছোঁড়ায় একজন পুলিশ সদস্যের মাথা ফেটে যায়। এসময় দুজন ছাত্রও গাড়ির সামনের আয়না ভাঙতে গিয়ে আহত হন।
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ইস্পাহানির মোড়ের দিক থেকে বড় একটি মিছিল আসে। এরপর যুবক বয়সী ৪-৫ জন এসে ফ্লাইওভারের নিচে আইল্যান্ডের উপর দাঁড়িয়ে আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ নেন। মাইক বাঁধা হয়। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা রাস্তার মাঝখানে বসে পড়েন। এসময় প্রায় আধাঘন্টার মতো যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
আন্দোলনে নেতৃত্বদাতাদের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন, সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের মুরাদ বাঙালি, কলেজিয়েট সরকারি স্কুল এন্ড কলেজের নয়ন রায় ও এহসান উদ্দিন, আগ্রাবাদ মা ও শিশু মেডিকেল কলেজের মাঈনুদ্দিন হাসান এবং ইসলামিয়া কলেজের অনিক নন্দী।
দুপুর ২টার দিকে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে মুরাদ বাঙালি ওয়াসার মোড়ের আন্দোলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, শনিবার (০৪ আগস্ট) সকাল ১১টায় আমরা আবারো ওয়াসার মোড়ে জড়ো হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করব।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ সমাবেশে সুচিত্রা বড়ুয়া নামে একজন অভিভাবকও বক্তব্য রাখেন। এছাড়া আরও কয়েকজন অভিভাবক শিক্ষার্থীদের মধ্যে এসে বিস্কুট বিতরণ করেন।
ছাত্রদের আন্দোলন দেখতে আসা সুমাইয়া শারমিন নামে এক গৃহিণী সারাবাংলাকে বলেন, ছাত্রদের আন্দোলন হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক আছে। তারাই পারবে। আমরা সন্তানদের রাস্তায় পাঠিয়ে আর দুশ্চিন্তায় থাকতে চাই না।
শিক্ষার্থী অনিক নন্দী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগামীকাল (শুক্রবার) দুপুরে জুমআ’র নামাজ আছে। এটি ধর্মীয় বিষয়। তাই এইদিনে আমরা কোন কর্মসূচি রাখিনি। তবে শনিবার আমরা আবারও রাস্তায় নামব। আমাদের নয় দফা দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব। তবে আমাদের আন্দোলন হবে শান্তিপূর্ণ।’
আন্দোলনরতদের মধ্যে ইস্পাহানি স্কুল এন্ড কলেজ, মহসিন কলেজ, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, ক্যামব্রিয়ান স্কুল, চট্টগ্রাম বিজ্ঞান কলেজ, কলেজিয়েট স্কুল, আন্তর্জাতিক ইসলামিক ইউনিভার্সিটি চিটাগং, ইউএসটিসিসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দেখা গেছে।
‘বাবাসোনা’ ডেকে রাস্তা থেকে সরানো হল শিক্ষার্থীদের
বিমানবন্দর থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত একমুখী সড়কটি চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রধান সড়ক হিসেবে বিবেচিত। এই সড়কের চারটি পয়েন্টে বিক্ষোভ শুরু করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। এগুলো হচ্ছে- নগরীর ইস্পাহানি মোড়, ওয়াসার মোড়, জিইসি মোড় এবং দুই নম্বর গেইট।
ইস্পাহানি মোড়ে অবস্থানের কারণে আশপাশে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে পুলিশ তাদের রাস্তা থেকে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। কোতয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন ‘বাবাসোনা’ ডেকে কাউকে কাউকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তাদের রাস্তা থেকে সরে গিয়ে আন্দোলন করার অনুরোধ করেন। ওসি’র আদরমাখা অনুরোধে কাজ হয়। শিক্ষার্থীরা ইস্পাহানি মোড় থেকে সরে গিয়ে ওয়াসার মোড়ে চলে আসেন।
তবে ওয়াসার মোড়ে আগে থেকে অবস্থান নেওয়ার নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহ মো.আব্দুর রউফ ও চকবাজার জোনের সহকারি কমিশনার নোবেল চাকমা শিক্ষার্থীদের মাথায় হাত বুলিয়ে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন। তারা শিক্ষার্থীদের ফ্লাইওভারের নিচে দুই আইল্যান্ডের মাঝে বসিয়ে সড়ক চালু রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন।
তবে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালামকে এসময় কার্যত অসহায় অবস্থায় ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে। এমনকি বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ওয়াসার মোড়ে পুলিশ বক্সে হামলা চালাতে গেলে তখনও ওসিকে অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
ইস্পাহানির মোড় থেকে শিক্ষার্থীরা সরে যাবার পর ওয়াসার মোড়ে আসেন কোতয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন। রউফ এবং মহসিন মিলে আগের পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের বোঝানো শুরু করেন। শিক্ষার্থীদের ‘বাবাসোনা’ ডেকে, মাথায় হাত বুলিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে আইল্যান্ডের মাঝে নিয়ে যান।
একপর্যায়ে পুলিশের অনুরোধেই দুপুর ২টার দিকে তারা আন্দোলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
গুজবে বাড়ে উত্তেজনা
ওয়াসার মোড়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে নানা ধরনের গুজব। একবার সমাবেশ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়- আন্দোলনত চারজন শিক্ষার্থীকে পুলিশ থানায় ধরে নিয়ে গেছে। তাদের ছাড়ানোর জন্য থানা ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ঘোষণা করা হলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
দ্রুত অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার শাহ মো.আব্দুর রউফ গিয়ে তাদের জানান, কোন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়নি। এটা সম্পূর্ণ গুজব।
বিক্ষোভের মধ্যেই খবর আসে দুই নম্বর গেইট এলাকায় পুলিশ আন্দোলনরতদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। আবার কখনও খবর আসে পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে। মুহুর্তের মধ্যেই আন্দোলনকারীরা পুলিশের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে শুরু করেন। ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা।
সম্প্রতি ঢাকায় বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু এবং নৌপরিবহন মন্ত্রীর ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য নিয়ে রাজধানীতে আন্দোলন শুরু করেছেন বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা।
সারাবাংলা/আরডি/একে