মানবপাচারের ‘মূলহোতা’ তেজগাঁও কলেজের শিক্ষক!
২০ আগস্ট ২০১৮ ১৪:৩২
।। স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: বিদেশে লোক পাঠানোর নামে প্রথমে আগ্রহীদের বিদেশে পাচার করা হতো। পরে সেখানে তাদের আটকে রেখে দেশে আদায় করা হতো মুক্তিপণ। এসব অভিযোগে আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের বাংলাদেশের প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী মূলহোতা মোহাম্মদ আছেম (৩৫) নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আছেম রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের শিক্ষক বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সোমবার (২০ আগস্ট) সকাল ১১টার দিকে রাজধানীর মালিবাগের সিআইডি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম।
মোল্লা নজরুল বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের বাংলাদেশের প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী মূলহোতা মোহাম্মদ আছেম। তাকে গত ১৯ আগস্ট কাওরান বাজার এলাকা থেকে সিআইডি গ্রেফতার করে। আছেমের বাবা আনোয়ার হোসেন দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়ায় ছিলেন এবং তার বড়ভাই মোহাম্মদ খোবায়েদ সেও মালয়েশিয়ায়। এই সুবাদে তারা আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের সঙ্গে যোগ দেয়।’
এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, আছেম ২০১০ সালে তাদের সঙ্গে মানবপাচারে কাজ শুরু করে। আছেম ও তার ছোটভাই জাভেদ মোস্তফা মানবপাচারের জন্য তারা প্রথমেই বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় দালাল নিয়োগ করে। দালালরা লোক ঠিক করে নিয়ে আসে। এরপর তাদের কাছ থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার খরচ নিয়ে টেকনাফে নিয়ে যাওয়া হয়। টেকনাফ থেকে ট্রলারে করে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে রাখা হয়। সেখানে পাচারকৃত লোকদের আটকে রাখে, নির্যাতন করে বাংলাদেশে থাকা তাদের স্বজনদের কাছে মুক্তিপণ চায়। এরপর আছেম ও তার সহযোগিরা মুক্তিপণ আদায় করে। আর যারা মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হয় তাদের থাইল্যান্ডের জঙ্গলে মেরে ফেলা হয়।
আছেম পূর্ব রাজাবাজারে বসবাস করেন। তিনি তেজগাঁও কলেজের বিবিএ ডিপার্টমেন্টের প্রভাষক। তার গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার মৌলভীপাড়া এলাকায়। তার বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং ও মানবপাচারের তিনটি মামলা আছে। একটি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানায়, একটি রাজধানীর বনানী এবং অপর মামলাটি বাজিতপুর থানায় মানবপাচার আইনে করা হয়েছে। গত পাঁচদিন আগে তাকে সিআইডি গ্রেফতার করেছিল, কিন্তু তিনদিনের মাথায় তার জামিন হলে সে আবার বের হয়ে আসে।
সিআইডির এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারীরা কক্সবাজার সাগর চ্যানেল দিয়ে গত কয়েক বছরে হাজার হাজার মানুষকে মালয়েশিয়া পাচার করেছে। সাগর পথে মালয়েশিয়ার যাওয়ার সময় অনেক বাংলাদেশি মারাও গেছেন। এখনও অনেক মানুষ নিখোঁজ। তারা দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজার-থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ায় সাগর পথে মানবপাচার করে মুক্তিপণের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের মালিক হয়েছে।’
আছেম মুক্তিপণের টাকা তার ছোট ভাই মোস্তফা, মা খাদিজা বেগম এবং তার সহযোগী আরিফ, একরাম, ওসমান সারোয়ারের নামে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফে বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা এসব অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সংগ্রহ করে বলেও সিআইডির হাতে তথ্য এসেছে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘এই সংঘবদ্ধ চক্রটি কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে কাজ করছে। তারা গ্রুপ হয়ে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে। ২০১৪ সালে এই চক্রের সদস্যরা সিরাজগঞ্জের মাসুদকে মালয়েশিয়ায় পাচার করে। এরপর পাচারকারীরা ফোনে মুক্তিপণ হিসেবে ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা দারি করে। পরে মাসুদের বাবা আব্দুল ছালাম ইসলামী ব্যাংকের মহাখালী শাখার একটি অ্যাকাউন্টে ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা পাঠায়। কিন্তু এরপরও তার ছেলে মুক্তি না পাওয়ায় এই ঘটনায় তিনি উল্লাপাড়ায় একটি মামলা করেন।’
সিআইডি এই মামলাটি তদন্ত করে জানতে পারে একটি আন্তর্জাতিক সংঘবদ্ধ চক্র এই পাচারের সঙ্গে জড়িত। এভাবে মানুষ পাচার করে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তারা। এরপর সিআইডি অর্থ লেনদেনের প্রবাহ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের লিংক চার্ট থেকে একে একে জড়িতদের খুঁজে পায়। এরপর গত বছরের ২ মে মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে সিআইডি’র পুলিশ পরিদর্শক আব্দুর রাজ্জাক খান বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এরপর তদন্ত করে পুলিশ মানবপাচার চক্রের সব সদস্যের পরিচয় জানতে পারে।
আছেম মানবপাচারের টাকায় রাজধানীতে এসিএম করপোরেশন নামে একটি রিক্রটিং এজেন্সি খুলেছে। এই প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টেও অনেক টাকা ছিলো, কিন্তু সম্প্রতি ওই প্রতিষ্ঠানের ফাইন্যান্স ম্যানেজার আরিফুজ্জামান আকন্দ ওরফে আরিফ তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নিয়েছে। সেই সঙ্গে আছেম পাচারের টাকা দিয়ে টেকনাফে বাড়ি ও জমি কিনেছে। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লাতেও জমি কিনেছে বলে জানান সিআইডি কর্মকর্তা নজরুল।
সারাবাংলা/এসএইচ/এমও