প্রতিবন্ধিতা ছাপিয়ে দুরন্ত যাত্রা
২২ আগস্ট ২০১৮ ১১:১৩
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: মসজিদে ঈদের নামাজ পড়ছেন মুসল্লিরা। তাদের গায়ে গোলাপি, নীল, হলুদ, সবুজ রঙের পাঞ্জাবি। মসজিদের ঠিক সামনেই ঈদের কোলাকুলি করছেন দু’জন। আর তার পাশে দু’টি বাচ্চা ঈদের আনন্দ করছে। তার পাশেই বাবার সঙ্গে এক কিশোর ছেলে এসেছে মাটির তৈরি পণ্য কিনতে।
ঈদের আমেজ ছড়ানো এমন একটি চিত্রকল্প ফুটে উঠেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ঈদ কার্ডে। ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে বেছে নেওয়া এই ছবিটির শিল্পী ১৮ বছরের তরুণী দুরন্ত। তবে আর দশটি স্বাভাবিক তরুণীর মতো তিনি নন, তিনি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন একজন মানুষ। তবে শারীরিক প্রতিবন্ধিতাকে ছাপিয়ে নিজের মেধার স্ফূরণ ঘটিয়েছেন তিনি।
দুরন্ত’র মা নাসরিন আহমেদ সারাবাংলাকে জানালেন, তার দুই মেয়ে দুরন্ত-অনন্ত। ১৮ বছরের এ দুই বোনই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। প্রায় তিন বছর আগে তাদের বাবা মারা যান। তারপর থেকে দুই মেয়েকে নিয়ে এক সংগ্রামী জীবনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কাজী রিয়াজুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে, প্রতিটি মানুষকে সমান অধিকার দিতে হবে। সেখানে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষকে যদি আমরা সুযোগ না দিই কিংবা জায়গা করে না দিই, তাহলে তারা সমাজের মূল স্রোতে মিশতে পারবে না। তারা পিছিয়ে পড়া মানুষ হিসেবেই থেকে যাবে। সে কারণেই পিছিয়ে থাকা মানুষ অথবা শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী যারা আছে, তাদের প্রতি আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে।’
কাজী রিয়াজুল বলেন, ‘ছবিটি যখন নেওয়া হয়, তখন তাকে একটা সম্মানি দেওয়া হয়। এতে করে তার মধ্যে যেমন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একটা ইচ্ছা জাগ্রত হয়, সেটাই আমরা চাই। তাছাড়া এর মাধ্যমে তো ওদের সহায়তাও হয়।’
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘অনন্ত-দুরন্তর বাবা কয়েকবছর আগে মারা যান। ওদের মা অত্যন্ত কষ্ট করে দুই বোনকে মানুষ করছেন। ওরা দুই বোন খুব ভালো ছবি আঁকে, নাচ করে। ওদের এসব গুণাবলি যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি, তাহলেই আসলে ওদের বিকাশের সম্ভাবনা তৈরি হবে। আমাদের ঈদ কার্ডে দুরন্তর ছবি বেছে নেওয়ার উদ্দেশ্যটাই হলো ওদের প্রমোট করা, ওদের সম্পর্কে সবাইকে জানানো। দেশে এত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারা যদি এসব বাচ্চাদের আঁকা ছবি দিয়ে ক্যালেন্ডার করে, তাহলে তো সেটা অনেক বড় একটি সাপোর্ট হয় ওদের জন্য।’
এই দুই বোন পড়ালেখা করছেন মোহাম্মদপুরের স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেনে। সেখানকার পরিচালক মারুফা হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রায় ১২/১৩ ধরে ওরা এই স্কুলে পড়ছে। ছোটবেলায় ওরা অসম্ভব জেদ করত, আচরণগত অনেক সমস্যা ছিল। স্কুলের শিক্ষকদের নির্দেশনা একদমই মানতে চাইত না, ছবি আঁকতে পারত না, গাইতে পারত না, নাচতে পারত না। বলতে গেলে কিছুই পারত না ওরা। কিন্তু গত ১২/১৩ বছরে ওরা এর প্রায় সবগুলোই রপ্ত করেছে।’
এই দুই বোন নিজেদের মধ্যে রহস্যময় একটি ভাষায় কথা বলে, যা অন্যরা কেউ বোঝে না বলেও জানান মারুফা হোসেন। তিনি বলেন, ‘ওদের দু’জনের আলাদা ভাষা আছে। এটা ভীষণ ইন্টারেস্টিং। ওদের মধ্যে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। ভবিষ্যতেও অনেক ভালো করবে ওরা।’
স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেনের পরিচালক আরও বলেন, ‘কয়েকবছর আগে হঠাৎ করেই ওদের বাবা মারা যাওয়াতে পড়ালেখায় খানিকটা ছন্দপতন হয়েছে, স্কুলটা নিয়মিতভাবে করতে পারছে না। তবে বাবা বেঁচে থাকতে স্কুলের অর্ধেক খরচ ওদের বহন করতে হতো। এখন ওদের পড়ালেখা ও স্কুলে যাতায়াতের যাবতীয় খরচ স্কুল কর্তৃপক্ষ বহন করছে।’
কেবল পড়ালেখায় সহায়তা নয়, দুরন্ত-অনন্তর ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের চিন্তাও করেছেন মারুফা। দুই বোন বিশেষ করে বেকিং জাতীয় রান্না ভালো করে বলে তাদের কিছুটা পুঁজি দেন তিনি। সেই টাকা দিয়ে ওরা কিছু খাবার রান্না করে স্কুলে এনে বিক্রি করবে— এমন পরিকল্পনা ছিল তার। একসময় হয়তো স্কুলে বিক্রি করা খাবার থেকেই ওদের জন্য বড় পুঁজি তৈরি হবে এবং তখন হয়তো নিজেরা কোথাও বেকারি দিতে পারবে— এমনটাই আশা স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেনের এই পরিচালকের।
অনন্ত-দুরন্তর এমন অর্জন অবশ্য নতুন নয়। এর আগে গত রোজার ঈদে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় তাদের ঈদ শুভেচ্ছা কার্ডে অনন্তর ছবি ব্যবহার করেছিল।
কেমন লাগে মেয়েদের এমন অর্জনে— জানতে চাইলে নাসরিন আহমেদ বলেন, ‘কষ্টের ফল সবসময় ভালো হয়। তাই আমার অনুভূতিও ভালো।’
তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। অর্থনৈতিক কারণে ওদের স্কুলে যাতায়াত নিয়েই অনিশ্চয়তা ছিল। পরে স্কুল ওদের পাশে দাঁড়িয়েছে, স্কুলের সব খরচ মওকুফ করে দেওয়া হয়েছে। গত ঈদে অনন্তর ছবি দিয়ে কার্ড করার পর এবার দুরন্তর ছবি দিয়েও ঈদ কার্ড হয়েছে। এসব ছোট ছোট বিষয়গুলোও আমার জন্য অনেক সহায় হয়ে আসে। এই সুবিধাগুলো না থাকলে আমাকে আরও অনেক কষ্ট করতে হতো।’
মেয়েদের নিয়ে যতদূর সম্ভব এগিয়ে যেতে চান নাসরিন আহমেদ। এই সংগ্রামে সবাইকে পাশেও চান তিনি। তবে মেয়েদের নিয়ে ভীষণ গর্বিত তিনি। নাসরিন বলেন, ‘আমি মনে করি, আমার এ দুই মেয়ে সৃষ্টিকর্তার দান। আমি স্পেশাল বাচ্চাদের মা। একজন ভাগ্যবতী মা। আমি এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। এর মাঝেও যখন ওদের কোনো কাজে সম্মানিত হই, সেটা আমার জীবনের অনেক বড় পাওয়া।’
সারাবাংলা/জেএ/টিআর
ঈদ কার্ড জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দুরন্ত-অনন্ত শারীরিক প্রতিবন্ধিতা