Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম নেওয়া শিশুর হিসাব নেই কারও কাছে!


২৫ আগস্ট ২০১৮ ১৯:২৪

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: উখিয়া-কুতুপালং হিন্দুপাড়া শরণার্থী শিবিরের একেবারেই পেছনের দিকের একটি ঘরে স্মৃতি রুদ্র-যদুরাম রুদ্র দম্পতির বসবাস। তাদের অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে গিয়ে দেখা গেল, ১০ দিনের নবজাতককে কোলে নিয়ে বসে রয়েছেন স্মৃতি। পাশেই চার বছরে সন্তান রনি আর দুই বছরের স্মরণীকাকে ভাত খাওয়াচ্ছেন যদুরাম।

গত বছরের আগস্টের এক রাতে পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলেন যদুরাম রুদ্র। এখানে এসে তাদের ঠাঁই হয় হিন্দুপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে। দিন দশেক আগে এখানকার এই স্যাঁতস্যাঁতে ঘরেই প্রতিবেশি বৃদ্ধার হাতে জন্ম নেয় তাদের তৃতীয় সন্তান।

জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেন কিনা— জানতে চাইলে লজ্জা পান স্বামী-স্ত্রী দু’জনই। পরে স্মৃতি জানান, কখনোই তারা এমন কোনো ব্যবস্থা নেননি। এ বিষয়ে কোনো ধারণাও তাদের নেই।

ঠিক দুই ঘর পরেই ববিতা রুদ্রের ঘর। তিন সন্তানের জননী ৩০ বছরের ববিতা এখন ফের আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। শুধু তাই নয়, আরো সন্তান নিতে আগ্রহী এ ববিতা ও তার স্বামী। আর জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি সম্পর্কে কোনো ধারণা বা আগ্রহ নেই তাদেরও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিনই জন্ম নিচ্ছে শিশু। গত বছরের আগস্টে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে শুরু করার পর থেকেই বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সর্ম্পকে সচেতন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ওই সময় তাদের জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উপকরণও দেওয়া হয়, কিন্তু সেসব তারা গ্রহণ করেননি। জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এ জনগোষ্ঠীর কোনো সচেতনতা নেই, নেই কোনো আগ্রহও।

বিজ্ঞাপন

শনিবার (২৫ আগস্ট) বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে এক বছর পূর্ণ করছেন দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসা এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এই একবছরের নিজ দেশে ফেরত যাবার বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক ‘দেন-দরবার’ হলেও সেখানে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঢল নামার পর থেকে দক্ষিণের জেলা কক্সবাজার পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আশ্রয় শিবিরে।

এখানকার পাঁচটি আশ্রয় শিবিরে স্থান হয়েছে প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গার। এই এক বছরে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ঠিক কতো শিশুর জন্ম হয়েছে, সে নিয়ে সঠিক কোনও পরিসংখ্যান সরকারি-বেসরকারি কোনও সংস্থার কাছেই নেই। আবার যে তথ্যটুকুও পাওয়া যায় সে নিয়েও রয়েছে ভিন্নতা।

বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে এবং মানবিক সহায়তা দানকারী সংস্থাগুলোর সহায়তায় প্রণীত জেআরপি’র (জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান বা যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনা) তথ্য অনুযায়ী, ৩০টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৫২টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ৪০টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও ১০টি হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু এসব কেন্দ্রে স্বাস্থ্য সেবা নেওয়া প্রসূতির সংখ্যা খুবই কম।

গত ১৬ মে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ জানায়, রোহিঙ্গ ক্যাম্পে প্রতিদিন ৬০টি করে শিশুর জন্ম হচ্ছে। অপরদিকে, আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্যা চিলড্রেন থেকে জানা যায়, সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও চলতি বছরে প্রতিদিন ১৩০টি শিশুর জন্ম হবে বলে মনে করছে তারা।

আবার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্রাকের কাছেও এসংক্রান্ত সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে ব্র্যাক পরিচালিত এক জরিপে পাওয়া গেছে আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার ২৬২ জন নারী সন্তান প্রসব করবেন।

বিজ্ঞাপন

ব্র্যাকের কমিউনেক্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের প্রধান শামীম ইফতেখার সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিদিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কতশিশুর জন্ম হচ্ছে এর সঠিক পরিসংখ্যান আসলে সেভাবে পাওয়া যাবে না।’

ক্যাম্পে মোট ২ লাখ ১৫ হাজার হাউজহোল্ড রয়েছে এবং এর মধ্যে ব্র্যাক ৪০ হাজার হাউজহোল্ডের ওপরে একটি জরিপ চালায় জানিয়ে শামীম ইফতেখার বলেন, ‘পরিসংখ্যানে ৪ হাজার ২৬২ জন গর্ভবতী নারী রয়েছেন। যারা আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে সন্তান প্রসব করবেন। সে দিক থেকে ২ লাখ ১৫ হাজারের মধ্যে ২০ হাজারের বেশি গর্ভবতী নারী রয়েছেন।’

শামীম ইফতেখার আরও বলেন, ‘আমাদের যেমন ক্লিনিক হাসপাতালে গিয়ে সন্তান প্রসব হয় সেরকম অবস্থা বা মানসিকতা আসলে রোহিঙ্গা নারীদের নেই। যার কারণে এসব ক্যাম্পে ৭০ শতাংশ নারী সন্তান প্রসব করেন ঘরেই, তারা কোনও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যান না এবং এ কারনে সঠিক পরিসংখ্যানটা পাওয়া যাবে না।’

আবার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কাজ করছে এমন একটি সংস্থার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ক্যাম্পগুলোতে কত গর্ভবতী নারী রয়েছেন এর কোনও সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। যেটা শুরু থেকে ধারণা করা হয়েছিল সেই সংখ্যা ধরেই সংস্থাগুলো কাজ করছে, যদিও এ সংখ্যা বাড়তে পারে বা কমতে পারে।’

ক্যাম্পের‘ উইম্যান ফ্রেন্ডলি স্পেসে’ নারীরা বলছেন, ‘নারীরা জন্ম নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী হলেও তাতে পুরুষরা আগ্রহী নয়। এখানে যদি কোনও নারী গর্ভবতী না থাকে সেক্ষেত্রে ক্যাম্পের ভেতরেই ধর্ষিত হবার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়-এরকম একটি কনসেপশন ক্যাম্পে রয়েছে। যার কারণে এখানে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি একেবারেই গড়ে ওঠেনি।’

রোহিঙ্গা শিবিরে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি একেবারেই কার্যকর নয় জানিয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম সারাবাংলা’কে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ও অন্ধকারে ছিল। ফলে এটা নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। তা সত্ত্বেও তাদের সচেতন করার জন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো কাজ করে যাচ্ছে।’ এ পরিস্থিতিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে রোহিঙ্গাদের মনোভাব সহসাই বদলাবে— এমন ভাবনাকে অমূলক বলে মনে করছেন আবুল কালাম।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর সারাবাংলা’কে বলেন, ‘ক্যাম্পগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি কন্ট্রাসেপটিভ দেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। পাঁচ বছর মেয়াদি ইমপ্ল্যান্ট তাদের জন্য সাজেস্ট করা হচ্ছে।’

জন্ম নিয়ন্ত্রণের এসব পদ্ধতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জন্য কতটুকু কার্যকর হতে পারে— জানতে চাইলে এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘তাদের বোঝানো হচ্ছে। কিন্তু কাজটা খুব কঠিন।’
রাখাইনে ‘ফ্যামিলি প্ল্যানিং’ বলে কিছু ছিল না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘নভেম্বর থেকেই সরকার এ বিষয়ে কাজ করছে। এখন জাতিসংঘের ইউএনএফপিএ-ও কাজ করছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হচ্ছে। কিন্তু এতে আদৌ কোনো কাজ হচ্ছে কিনা, সেটা বলা মুশকিল।’

সারাবাংলা/জেএ/এমও

রোহিঙ্গা রোহিঙ্গা ক্যাম্প

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর