‘নোট অব ডিসেন্টে’ যা লিখেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব
৩০ আগস্ট ২০১৮ ১৬:৩২
।। গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের মাধ্যমে ভোটগ্রহণের নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিদ্ধান্তে ভিন্নমত জানিয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছেন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তাতে নিজের পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার বিভিন্ন কারণ তুলে ধরেছেন তিনি।
ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতৈক্যে পৌঁছাতে না পারা, অল্প সময়ের মধ্যে ইভিএম প্রকল্পের বরাদ্দ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারার সক্ষমতা, বিনা টেন্ডারে কেনা ইভিএমের কারিগরি পরীক্ষায় ঘাটতি, ইভিএম ব্যবহারে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব, ইভিএম নিয়ে ভোটারদের অনভ্যস্ততা ও ইভিএম ব্যবহারে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কার কারণে মাহবুব তালুকদার একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে আরপিও সংশোধনে ইসির উদ্যোগ সমর্থন করেন না বলে উল্লেখ করেছেন।
ইভিএমের বিরোধিতা করে নির্বাচন কমিশনার মাহবুবের সভা বর্জন
রাজনৈতিক দলগুলো সম্মত হলেই কেবল আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে— প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার এমন বক্তব্য উল্লেখ করে ‘নোট অব ডিসেন্টে’ মাহবুব তালুকদার বলেন, স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। সরকারি দলের পক্ষ থেকে ইভিএম ব্যবহারকে স্বাগত জানানো হলেও প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করে আসছে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দলগতভাবে সংলাপেও ইভিএম সম্পর্কে সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দলের অবস্থান ছিল পরস্পরবিরোধী।
এ অবস্থায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতেক ইভিএম ব্যবহারের কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মন্তব্য করেন মাহবুব তালুকদার। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অধিকতর আলোচনা ও সমঝোতার প্রয়োজন ছিল বলে মত দেন দিনি।
এর আগেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে ভিন্নমত জানিয়েছিলেন এই নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেন, গত ৩ এপ্রিল পরীক্ষামূলক ব্যবহারের জন্য ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০টি ইভিএম কেনার বিষয়ে ভিন্নমত জানিয়েছিলাম। সম্প্রতি ইভিএম কেনার জন্য যে প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে, তার ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার মুখে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে ইভিএম কেনা কতটা যৌক্তিক— সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
মাহবুব তালুকদার বলেন, সরকারি সংস্থা বিবেচনায় বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) থেকে বিনা টেন্ডারে ইভিএম মেশিন কেনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই ইভিএম মেশিনের উৎস কী কিংবা কোথা থেকে এটি আমদানি করা হচ্ছে— সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এই মেশিন সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত কিনা, তা আরও পরীক্ষা করার প্রয়োজন ছিল। প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর পর এখন পর্যন্ত প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি বলে জানা গেছে।
আরপিও পাল্টে ৩৮২৯ কোটি টাকায় তড়িঘড়ির ইভিএম!
ব্যক্তিগতভাবে ইভিএম ব্যবহার করে ভোটগ্রহণের বিরোধী নন জানিয়ে মাহবুব তালুকদার লিখেছেন, ইভিএম ব্যবহারে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঘাটতি রয়েছে। ইভিএম ব্যবহার নিয়ে প্রশিক্ষণ অপর্যাপ্ত ও অনেক ভোটার অজ্ঞতাপ্রসূত কারণে ইভিএম ব্যবহার সম্পর্কে অনীহা জানিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, ইভিএম নিয়ে ভোটারদের সন্দেহ নিরসনে ব্যাপক প্রচার ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম ব্যবহারে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার উল্লেখ করে এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, সিটি নির্বাচনে একটি দলের পক্ষে ভোট দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। তবে আমি মনে করি, স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ধীরে ধীরে ইভিএমের ব্যবহার বাড়ানো হলে ভোটাররা তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন। এই অভ্যস্ততার জন্য সময়ের প্রয়োজন। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে সেই সময় দেওয়া সম্ভব নয়। তবে স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবস্থা সাফল্য লাভ করলে ৫ বছর পরে জাতীয় নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহার অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।
সর্বসম্মত রাজনৈতিক মতের বিরুদ্ধে ইভিএম ব্যবহার করা হলে তা নিয়ে আদালতে অনেক মামলার সূত্রপাত হতে পারে বলে আশঙ্কা জানিয়ে মাহবুব তালুকদার বলেন, ফলে অন্যান্য কারণ বাদ দিলেও কেবল ইভিএম ব্যবহারের কারণেই আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা আছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এই অনাবশ্যক ঝুঁকি নেওয়া সঙ্গত হবে না।
এসব অভিমতের আলোকেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ সমর্থন করেন না উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তে ভিন্নমত জানিয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।
আরও পড়ুন-
আরপিওতে সংযোজন হচ্ছে ইভিএম ব্যবহার
ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন, ১০০ আসনে ‘ইভিএম ব্যবহার’
সারাবাংলা/জিএস/টিআর