‘ভুল চিকিৎসায় বাবাকে মেরে উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিচ্ছে’
২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ২২:২৭
।। সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ‘অনভিজ্ঞ একজনকে দিয়ে অপারেশনের আগে ভুল অ্যানেসথেশিয়া করিয়ে আমাদের বাবাকে মেরে ফেলেছে তারা। সে দায়ও তারা স্বীকার করেছে লিখিত ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে। কিন্তু তারপরও তারা আমাদের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের জন্য নাকি থানায় অভিযোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অভিযোগ করার কথা ছিল আমাদের, উল্টো আমাদের নামেই নাকি অভিযোগ দেওয়া হবে!’
গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার বুড়িচং থেকে সারাবাংলাকে মোবাইল ফোনে কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাজধানীর পান্থপথ মোড়ের সোস্যাল ইসলামি ব্যাংক হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া ইঞ্জিনিয়ার জাহাঙ্গীর আলমের বড় মেয়ে রুপক জাহান সুমি।
গতকাল শনিবার (১ সেপ্টেম্বর) বিকেলে মৃত্যু হয় জাহাঙ্গীর আলমের। তার স্বজনদের অভিযোগ, পিত্তথলি পাথর অপসারণের অপারেশনের সময় ভুল চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়েছে।
স্বজনরা বলছেন, অপারেশনের সময় কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. রাজিবুল হক দাবি করেন, জাহাঙ্গীর আলম হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। জাহাঙ্গীরের পরিবারের পক্ষ থেকে চিকিৎসকের এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ করলে ওই চিকিৎসকসহ হাসপাতালের সব চিকিৎসক-নার্সসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আত্মগোপনে চলে যান। এতে রোগীর স্বজনদের সন্দেহ আরও বেড়ে যায়।
পরে জাহাঙ্গীর আলম ভুল চিকিৎসায় মারা গেছেন— রাত ১টার দিকে এমন একটি লিখিত মৃত্যু সনদে সই করেন অভিযুক্ত ওই চিকিৎসক ও অ্যানেসথেশিয়ার চিকিৎসক ইলিয়াসুর রহমান। সনদটি সত্যায়িত করেন হাসপাতালের আইসিইউ ও এইচডিএই’র প্রধান কনসালট্যান্ট সাঈদ তারেক রেজা। ওই সনদের একটি অনুলিপি এ প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।
মৃত্যু সনদ পাওয়ার পর জাহাঙ্গীর আলমের মরদেহ দাফনের জন্য গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার বুড়িচংয়ে নিয়ে যান তার স্বজনরা।
আরও পড়ুন- ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ, চিকিৎসক-নার্স পলাতক
এদিকে, গতকাল শনিবার বিকেল ৫টার পর থেকে ওই হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট সবাই পলাতক থাকলেও আজ রোববার (২ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে ফের চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে সোস্যাল ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালে। যদিও হাসপাতালটিতে সকাল ও বিকেলে দুই দফা গিয়ে দেখা যায়, প্রশাসনিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কেউ উপস্থিত নেই। কোনো চিকিৎসকের দেখাও মেলেনি।
হাসপাতালের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ডা. ক্যাপ্টেন যুবায়ের মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ওই রোগী ভুল চিকিৎসায় মারা যায়নি। তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। কিন্তু তার স্বজনরা এসে অযথা হট্টোগোল করেছিল। তারা হাসপাতালের রিসিপশনে কম্পিউটার ও সিসি ক্যামেরাসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ভেঙেছেন। এ কারণে আমরা আইনি ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছি। আমাদের ৫ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে— এমন অভিযোগের অভিযোগপত্র তৈরি করা হয়েছে। শিগগিরই আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেটি থানায় জমা দেবেন।
ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু না হলে শনিবার বিকেল থেকে সবাই পালিয়ে ছিলেন কেন— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা পালাইনি। তাদের হামলা থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে নিরাপদ স্থানে ছিলাম।
ডেথ সার্টিফিকেটে রোগীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে ভুল চিকিৎসা উল্লেখ করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই সময় রোগীর স্বজনরা আমাদের ওপর চাপ তৈরি করেছিল। যে কারণে আমরা তখন সেটি লিখতে বাধ্য হয়েছি বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য। আর সেটা করেছিলাম বলেই পরে তারা লাশ নিয়ে গেছে ও দাফন করেছে।
ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু উল্লেখ করা ডেথ সার্টিফিকেট পেলেও এখনও থানায় অভিযোগ করেননি জাহাঙ্গীর আলমের স্বজনরা। এ বিষয়ে জানতে তার বড় মেয়ে সুমি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আচমকা যে মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের সঙ্গে ঘটেছে, আমরা তো থানায় অভিযোগ দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থাতেই নেই। আমার ছোট ভাইও খুব ভেঙে পড়েছে। সে কারও সঙ্গে কথাও বলছে না। তার ওপর শুনছি, ওরা নাকি আমাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ দেবে!’ তবে দুয়েকদিনের মধ্যেই থানায় এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
সুমি আরও বলেন, ‘তারা তো মানুষ মারার মার্কেট খুলে বসেছে। অনভিজ্ঞ বাচ্চা ছেলেদের ডাক্তার বানিয়ে হাসপাতালে রাখছে। সেখানে যেসব রোগী এখনও ওটিতে আছে, তাদের পরিণতিও হয়তো আমার বাবার মতোই হবে।’
জানতে চাইলে কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইয়াসির আরাফাত খান সারারাবাংলাকে বলেন, ‘এ ঘটনা জানার পর গতকাল (শনিবার) হাসপাতালটিতে পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। তবে এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষের লিখিত অভিযোগ থানায় আসেনি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সারাবাংলা/এসএইচ/টিআর