বাস টার্মিনালে হাঁটু পানি, নগরজুড়ে যানজট ও দুর্ঘটনা
৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১১:৫৭
।। সরকার দুলাল মাহবুব, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট।।
রাজশাহী: রাজশাহী নগরীর যানজট কমাতে ও যাত্রী সেবা নিশ্চিত করতে নওদাপাড়ায় বিশাল জায়গা নিয়ে নির্মাণ করা হয় বাস টার্মিনাল। কিন্তু ৭ বছর আগে প্রায় সোয়া সাত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই টার্মিনাল কোনই কাজে আসছে না। এখান থেকে যাত্রীসহ বাস ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও টার্মিনালটি ব্যবহার হচ্ছে শুধু গ্যারেজ হিসেবে। পাশাপাশি নগরীতে যেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে বাস কাউন্টার। এতে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে যেমন যানজট বাড়ছে তেমন বাড়ছে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি।
সড়কগুলোতে অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন ও অদক্ষ চালকদের দৌরাত্মে প্রতিনিয়তই বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির কর্তৃপক্ষ সড়কে এই অরাজগতার জন্য বিআরটিএ, প্রশাসন ও সড়ক বিভাগকে দায়ী করছে।
এ দিকে আইনের তোয়াক্ক না করে টার্মিনালের যথাযথ ব্যবহার ছাড়াই নগরীর গুরুত্বপূর্ণ চারটি পয়েন্ট বা মোড়কে টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই পয়েন্টগুলোর ফুটপাত ও সড়ক দখল রেখে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে যাত্রী তোলার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাস দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে। তৈরি করা হয়েছে টিকেট কাউন্টার। ফলে নগরীর ওই সকল গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে সবসময় যানজট লেগেই থাকছে, সেই সাথে নগরীতে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। নগরীর ভদ্রার মোড়, তালাইমারী মোড়, বিন্দুর মোড় ও গ্রেটাররোড রেল ভবনের মূল প্রবেশদ্বারে দুর্ভোগের মাত্রা আরও বেশি।
বিশেষ করে ভদ্রা ও তালাইমারী মোড়ে রাজশাহী-নাটোর রুটে চলাচলকারী বাসগুলো যাত্রীদের জন্য সড়ক দখল করে অপেক্ষায় থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বিন্দুর মোড় থেকে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটের বাসগুলো যাত্রী তোলার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তা দখল করে। রেল ভবনের মূল প্রবেশদ্বারের সামনের রাজশাহী-নওগাঁ ও রাজশাহীর তানোর ও বাগমারা উপজেলায় চলাচলকারী বাসগুলো যাত্রী উঠাতে দাঁড়িয়ে থাকে।
ভদ্রা এলাকার বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম বলেন, তিনটি আবাসিক এলাকা রয়েছে এখানে। এর বাইরে রয়েছে স্কুল – কলেজ। অথচ ভদ্রা মোড়েই বসান হয়েছে বাসস্ট্যান্ড। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা এখানে যানজট লেগেই থাকে। অগোছালো বাসস্ট্যান্ডের কারণে কদিন আগেই একজন রিকশা আরোহী বাসের চাপায় মারা গেছেন। শুধু তাই না, সেখানে বাস টার্মিনালের কারণে প্রায় ছোট বড় দুর্ঘটনা ঘটছে।
সরেজমিনে নগরীর নওদাপাড়া বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, এর প্রবেশ দ্বারগুলো বৃষ্টির পানিতে ডুবে রয়েছে, আশপাশে জঙ্গল গজিয়েছে। ভেতরটা বাসে ঠাসা। এর মাঝে নতুন করে কিছু বাস প্রবেশ করছে আবার কিছু বাইরে বের হচ্ছে। তবে কোন বাসেই যাত্রী নেই।
এই বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া বেশ কয়েকটি বাসের চালকদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, এখানে তারা বাসগুলো রেখে বিশ্রাম নেন। আবার সিডিউল টাইমে টার্মিনাল ছেড়ে মূল শহরের চিহ্নিত পয়েন্টগুলোতে গিয়ে যাত্রী নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। বাস টার্মিনাল হওয়ার পরেও এখানে কেন যাত্রী তোলা হয় না এমন প্রশ্নে তারা বলেন, টার্মিনালটি শহর থেকে দুরে হওয়ায় যাত্রীরা এখানে আসতে চায় না। তাই এই টার্মিনালটি এখন বাস-ট্রাকের গ্যারেজ ও বছরে বাস শ্রমিক ইউনিয়নের মেলা বসানোর জন্য ব্যবহার করা হয়।
রাজশাহী নগরীতে প্রতি বছরই জনসংখ্যা বাড়ছে। এই মানুষগুলোর চলাচলের সুবিধার্থে নগরীতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা। স্থানীয়দের দেয়া তথ্যমতে এই মুহূর্তে নগরীতে শুধুমাত্র ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার সংখ্যাই রয়েছে প্রায় ২০ হাজার। প্রতিদিন নামছে আরও নতুন নতুন অটোরিকশা। এর বাইরে রয়েছে প্রায় ৫ হাজার সবুজ রঙের সিএনজি। যানবাহনের সংখ্যা বাড়লেও সে অনুপাতে নগরীর সড়কগুলো প্রশস্ত হয়নি। শুধু যাত্রী উঠানোর কাজই না। বাসগুলো পরিষ্কার করার কাজে যেখানে সেখানে পার্কিংও করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুর হক বলেন, নগরীতে যেখানে সেখানে দাঁড় করিয়ে বাসগুলো পানি দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। এক জায়গা সবসময় ভেঁজা থাকার কারণে সড়কের বিটুমিন নষ্ট হয়ে পাথর উঠে যাচ্ছে। রাস্তায় খানাখন্দের পরিমাণ বাড়ছে। এর বাইরে নগরীতে যে সকল গাড়ির গ্যারেজ রয়েছে সেই গ্যারেজগুলোতে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় ট্রাক-বাস মূল সড়কে রেখেই মেরামতের কাজ করছে তারা। এতে করে সড়কে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে, সেই সাথে বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।
সড়ক পরিবহন সমিতির অভিযোগ রাজশাহী শহরের পাশাপাশি আশপাশের উপজেলাগুলোর সকল সড়কের ধারণ ক্ষমতার চাইতে অটোরিকশা ও সিএনটি চালিত যানবাহনের সংখ্যা বেশি। এই সকল যাববাহনের দৌরাত্ম্যে সড়কে নিরাপদে বাস-ট্রাক চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। ঘটছে প্রাণহানীর মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। রুটপারমিট ও লাইসেন্সবিহীন সিএনজি রাজশাহীর প্রধান সড়কগুলো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ছুটছে এক উপজেলা থেকে আরেক উপজেলায়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সহ-সভাপতি মুনজুর রহমান পিটার সড়কে অরাজগতার জন্য সড়কবিভাগ, প্রশাসন ও বিআরটিএ বিভাগকে দায়ী করেন তিনি। রাজশাহী থেকে পুঠিয়া যেতে বাস ভাড়া ২০ টাকা। আর রাজশাহী শহর থেকে নওদাপাড়া বাস টার্মিনালে যেতেই ভাড়া লাগবে ২০ টাকা। আবার অটোরিকশা, সিএনজি ও ইমা রাজশাহীর কোর্ট থেকে সরাসরি পুঠিয়া, গোদাগাড়ি নওগাঁ চলে যাচ্ছে। সাধারণ যাত্রী কেন পকেটের টাকা খরচ করে ওই টার্মিনালে যাবে। আমরা বারবার প্রশাসনকে অনুরোধ করে বলেছি প্রধান সড়কে তিন চাকার যান বন্ধ করতে। তাদেরকে শহরে মধ্যে রাখতে। এই বিষয়গুলো সমাধান আগে হওয়া প্রয়োজন। তবেই রাজশাহীর সড়কে দুর্ঘটনা, যানজট ও দুর্ভোগ কমান সম্ভব। আর তখনই যাত্রী ও বাস এমনিতেই টার্মিনাল মুখি হবে।
তিনি অভিযোগ করেন, রাস্তায় একটি বাস নামাতে সরকারকে দুই লাখ টাকা ট্যাক্স দিতে হয় মালিক পক্ষকে। এছাড়াও পদে পদে ঘুষ দিতে হয়। রাজশাহী থেকে চট্টগ্রাম যেতে একটি গাড়িকে রাস্তায় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা ঘুষ বা চাঁদা দিতে হয়। এর বাইরে রাস্তায় চলতে গেলে গাড়ির রং চটে যেতে পারে, সেই রং চটা দেখিয়ে ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এসব বন্ধ হওয়া খুব জরুরি।
বিআরটিএ প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির আখড়া উল্লেখ করে সড়ক পরিবহন সমিতির এই নেতা বলেন, সড়কে যতটুকু দরকার তার চাইতে বেশি লাইসেন্স দিচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান। রুট পারমিট নিয়ে তারা সময় পার করে। সড়কে তাদের মনিটরিং টিম কাজ করে না। প্রধান সড়কে তিন চাকা যান চলাচল বন্ধ করলেই সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমে যাবে।
সারাবাংলা/এমএইচ/ডেডএফ