কাচ বিভ্রম: মধ্যযুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় পাগলামী
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৩:১৯
।। আখিউজ্জামান মেনন ।।
মধ্যযুগের শেষভাগে এবং আধুনিক যুগের শুরুর দিকে ইউরোপে দেখা দেয় এক অদ্ভুতুড়ে মানসিক রোগ। এই রোগে আক্রান্ত লোকজন নিজেদের কাচে-গড়া মানুষ ভাবতে শুরু করেন। সময়ের পরিক্রমায় রোগটি বাহারি একটা নামও জুটিয়ে ফেলে নিজের কপালে- যার নাম গ্লাস ডিলিউশন, কাচ বিভ্রম।
বিশেষজ্ঞরা না হয় বিভ্রম নাম দিলেন কিন্তু এই রোগে আক্রান্তদের ছিল নিজেদের ভাবনার টনটনে বিশ্বাস। গ্লাস ডিলিউশনে ভোগা বিখ্যাত ফরাসী রাজা ষষ্ঠ চার্লসতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থির হয়ে বসে থাকতেন; তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, সে এদিক-ওদিক ভুল চলাফেরা করলেই তার কাচের শরীর ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।
নিজের নাম ভুলে যাওয়া, স্ত্রীকে চিনতে না পারাসহ আরও বহুমুখী মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ষষ্ঠ চার্লসের গ্লাস ডিলিউশনে ভোগার বর্ণনা পাওয়া যায় দ্বিতীয় পোপ পিইয়ুসের (Pope Pius II) Commentaries এ। পিইয়ুসের লেখায় আছে রাজা ষষ্ঠ চার্লস বিভ্রমে আক্রান্ত হওয়ার পর প্রায় সময়ই নিজের কাপড়ে লোহার টুকরা সেলাই করে রাখতেন যাতে করে তার সংস্পর্শে কেউ আসলেও যেন তার কাচের-দেহে কোনো আঘাত না লাগে। এমনকি শীত-গ্রীষ্মের তোয়াক্কা না করে রাজা ষষ্ঠ চার্লস সারাক্ষন একগাদা পাতলা কম্বলে নিজেকে জড়িয়ে রাখতেন। কারণ? সেই একই- এই বুঝি কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লেগে কাচে তৈরি হাত-পা, নিতম্ব ঝনাৎ করে চুর্ণ হয়ে গেল।
অনেকের মতে, ১১ বছর বয়সে সিংহাসনে বসা রাজা ষষ্ঠ চার্লসের মা জোয়ান অফ বোরবন (Joan of Bourbon)-এর বংশে পাগলামির একটা ইতিহাস ছিল। এরই ধারাবাহিকতা দেখা যায় ষষ্ঠ চার্লসের মেয়ের ঘরের নাতি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত রাজা ষষ্ঠ হেনরির ক্ষেত্রে- নানা চার্লস চিনতে পারেননি স্ত্রীকে আর নাতি পারেনি সদ্য জন্মানো নিজ সন্তানকে।
গ্লাস ডিলিউশনে ভোগা আরেক বিখ্যাত মানুষ হলেন জার্মানির বাভারিয়ার (Bavaria) সম্রাজ্ঞী আলেকজান্দ্রা এমিলি (Alexandra Amalie)- ১৮৪০ এর শেষভাগ তখন, রাজপ্রাসাদের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল ২৩ বছর বয়সী সম্রাজ্ঞী এমিলি। আত্মীয়-স্বজন এমিলির চলাফেরায় অদ্ভুত এক বৈশিষ্ট্য খেয়াল করলো- সম্রাজ্ঞী পাশ ফিরে ফিরে চলফেরা করছে। শুধু কী তাই! আঙুলে ভর দিয়ে হাঁটতে থাকা সম্রাজ্ঞী আলেকজান্দ্রা নিজের শরীরের সঙ্গে কোনো কিছুকেই স্পর্শ করতে দিচ্ছিলেন না। সে সময়টায় সাদা রঙ ছাড়া অন্য আর কোনো রঙের কাপড় পরা বন্ধ করে দেন তিনি।
পরিবারের লোকজনের জিজ্ঞাসায় সম্রাজ্ঞী তার আচরণের কারণ জানায়- সে ছোটবেলায় একটা আস্ত কাচের পিয়ানো খেয়ে ফেলে; পিয়ানোটা এখনো তার ভেতরে অক্ষত অবস্থায় রয়ে গিয়েছে, চলাফেরায় খানিক ভুল হয়েছে তো পিয়ানো ভেঙ্গে গিয়ে কাচে নাড়িভুঁড়ি সব কেটে যাবে- গ্লাস ডিলিউশন আর কী!
রবার্ট বার্টন মধ্যযুগে রাজপরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের এ জাতীয় মানসিক রোগে ভোগাকে বিষাদের ফলাফল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
১৬১৩ সালে প্রকাশিত মিগুয়েল ডি কারভান্তেস (Miguel de Cervantes)-এর দ্য গ্লাস গ্রাজুয়েট (The glass graduate) গল্পের নায়ক তরুণ আইনজীবী টমাস রোদাজা (Tomas Rodaja) এফ্রোডিজিয়াক বিষের (Aphrodisiac potion) শিকার হয়ে নিজেকে কাচে সৃষ্ট মানুষ ভাবতে শুরু করেন এবং রোদাজা দাবি করেন কাচে পরিণত হওয়ায় পর থেকে তার বোধশক্তি বা চৈতন্য রক্ত-মাংসের মানুষের তুলনায় হাজারগুণ বেশি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
ফরাসি দার্শনিক রনে দেকার্ত তার Meditation on First Philosophy (1641) গ্রন্থে গ্লাস ডিলিউশনকে উন্মাদনার উদাহরণ উল্লেখ করে বলেন, এই রোগে ভোগা ব্যক্তিদের পৃথিবী সম্পর্কে অনুভূত জ্ঞান বেশিরভাগ মানুষের চিন্তা থেকে আলাদা। একই আলোচনায় দেকার্ত উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন মানসিক রোগে আক্রান্ত অনেকে নিজেদের কুমড়া কিংবা রাজা ভাবে, দেকার্ত ঘোষণা দেন- তারা সবাই উন্মাদ।
সপ্তদশ শতকে গ্লাস ডিলিউশনে পীড়িত ব্যক্তিদের আরেক ধরণের বিশ্বাস ছিল যে তাদের নিতম্ব কাচের, তাই তারা সবসময় পিছনে বালিশ বেঁধে রাখতো, কোথায় না কোথায় শক্ত জায়গায় বসলো আর অমনি নিতম্বে আওয়াজ উঠলো- কড়মড়, সে জন্য বালিশ বাঁধার বুদ্ধি।
১৮৩০-এর দশকের পর থেকে লিখিত বিবরণীতে গ্লাস ডিলিউশনের কোনো ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় না। ধারণা করা যেতে পারে যে, সমাজ ও সংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষেরা এ ধরণের বিরল বিভ্রম কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিল।
কিন্তু নেদারল্যান্ডের মানসিক রোগের চিকিৎসক অ্যান্ডি ল্যামেইজন (Andy Lameijn) এক বক্তব্যে বলেন, তার একজন সহকর্মী এক ডাচ হাসপাতালের নথিপত্র ঘেটে ১৯৩০-এর দশকের গ্লাস ডিলিউশনে আক্রান্ত একজন মহিলার কথা জানতে পারে- সেই রোগী বিশ্বাস করতো তার পা এবং পিঠ কাচের তৈরি, হাসপাতালের নার্সদের সে মোটেও কাছে ভিড়তে দিতেন না; সে ভাবতো নার্সরা তাকে কাপড় পরিবর্তন বা অন্যান্য সাহায্য করতে গিয়ে তার কাচের পিঠ বা পা ভেঙ্গে ফেলবে।
লিডেনের (Leidin) বিশ্ববিদ্যালয় ক্লিনিকে একবার অ্যান্ডির কাছে একজন তরুণ এসে জোর দিয়ে বলে, সে বুঝতে পারে তার পুরো দেহ কাচের তৈরি। অ্যান্ডি তার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ করে তার অনুভূতি ঠিকভাবে বোঝার জন্য।
তরুণ জানালার দিকে নির্দেশ করে অ্যান্ডিকে জিজ্ঞেস করে সে কী কী দেখতে পাচ্ছে। রাস্তা, কিছু গাড়ি, অনেকগুলো দালান, হেঁটে যাওয়া মানুষ- উত্তর দেয় অ্যান্ডি। তরুণ অ্যান্ডিকে বলে জানালার কাচ অ্যান্ডির চোখ এড়িয়ে গিয়েছে, সে কাচ দেখতে না পেলেও কাচ ওখানে আছে। তরুণ তারপর অ্যান্ডির দিকে ঝুঁকে গিয়ে বলে, ‘That’s me. I’m there and I’m not there.’
সপ্তদশ শতকে লোকেদের কাছে স্বচ্ছ কাচ এক জাদুকরী বস্তু; বিশেষজ্ঞদের মতে সপ্তদশ শতকে প্রচুর মানুষের গ্লাস ডিলিউশনে ভোগার একটা কারণ হতে পারে কাঁচের প্রতি তাদের অতিরিক্ত মোহ।
১৯৩০-এর দশকে বা পরবর্তীতে যখন মানুষের কাচের প্রতি আগ্রহ ধূসরতায় মোড়ানো তখন কেনো গ্লাস ডিলিউশনে আক্রান্ত ব্যক্তির খবর পাওয়া যায়?
প্রশ্নের জবাবে মনঃবিশ্লেষক এডাম ফিলিপসের ব্যাখ্যা হচ্ছে লোকেদের আধুনিক যুগের দান উদ্বেগ, ভয় ও দুশ্চিন্তার কবলে পড়া।
ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের সিনিয়র লেকচারার নেইল সরেলকে (Neil Sorrel) তার ভাই ২০০৫ সালে এমন এক ব্যক্তির জন্য সঙ্গীত সৃষ্টি করতে বলে- যে ব্যক্তি ধীরে ধীরে কাচে পরিণত হয়ে যাচ্ছে; সরেলের শুধুমাত্র কাঁচের আওয়াজে সৃষ্ট ১৫ মিনিটের ভিন্নধর্মী সঙ্গীত BBC Radio-4 এ সম্প্রচার করা হয় ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে।
নিসন্দেহে বলা যায় রাজা ষষ্ঠ চার্লস অথবা এমিলি বা অ্যান্ডির সঙ্গে দেখা করতে আসা তরুণ কিংবা হাসপাতালের সেই মহিলা বেঁচে থাকলে সরেলের সঙ্গীত শুনে যারপরনাই খুশি হতেন।
সারাবাংলা/পিএম