আদালতে খালেদার ‘থাকা না থাকা’ যা হলো যুক্তিতর্কে
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৮:১৭
।। সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার হাজিরা দেওয়া না দেওয়া ইস্যুতে যুক্তিতর্ক শুনানি করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
বৃহস্পতিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) যুক্তিতর্ক শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে, এই মামলায় খালেদা জিয়ার হাজিরা মওকুফ করে বিচারকাজ অব্যাহত রাখা সম্ভব। অপরদিকে আসামিপক্ষ বলেছে, খালেদা জিয়া কারাগারে মানে তিনি বিচারকের কাস্টডিতেই আছেন। সুতরাং তাকে হাজির না করে মামলা চলার কোনো সুযোগ নেই।
বাদীপক্ষ দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘ফৌজদারি আইনের ৫৪০ (এ) অনুযায়ী কোনো আসামি উপস্থিত না হলে হাজিরা মওকুফ দেখিয়ে বিচার কাজ পরিচালনা করা সম্ভব। এই ক্ষেত্রে তার আইনজীবীরা যদি সহযোগিতা করতে অপরাগ হয় তাহলে এ মামলার রায়ের জন্য দিন ঠিক করে দিতে তারা আদালতের কাছে প্রার্থনা করেন’।
অন্যদিকে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেছেন, ‘এ মামলায় খালেদা জিয়াকে হাজিরা মওকুফ দেখিয়ে বিচার কাজ পরিচালনা করা সম্ভব না। কেননা তিনি (খালেদা জিয়া) এ বিচারকের কাস্টডিতেই রয়েছেন। তাকে আদালতে হাজির করার দায়িত্ব কারা কর্তৃপক্ষের। তাছাড়া তিনি অসুস্থ থাকায় আদালতে আসতে চাননি। আদালতে আসতে তিনি কেন অনিচ্ছুক সেটিও আমাদের জানতে হবে।
বৃহস্পতিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত অস্থায়ী বিশেষ আদালত-৫ এর বিচারক ড. আখতারুজ্জামানের আদালতে শুনানিকালে এসব যুক্তি তুলে ধরেন।
উভয়পক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শুনে আগামী ২০ সেপ্টেম্বর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতে জিয়া চ্যারিটেবল মামলার বিচার চলবে কি না এবং তার জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে আদেশের জন্য দিন ঠিক করে দেন আদালত।
বৃহস্পতিবার বেলা পৌনে ১২টায় আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়।
প্রথমেই দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল আজকের আইনগত আলোচ্য বিষয় কি সেটি উল্লেখ করে মামলার অপর দুই আসামির পক্ষে তাদের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শুরু করতে আদালতের কাছে আবেদন জানান।
এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, বেগম খালেদা জিয়া কেন আদালতে আসতে অনিচ্ছুক, কেন তিনি আদালতে আসতে চাচ্ছেন না, সেটা জানতে আজকে আমরা একটা পিটিশন দিয়েছি। ওই পিটিশনে আমরা দুইজন আইনজীবী তার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চেয়েছি। আমাদেরকে সময় দেন। আমরা উনার (খালেদা) সঙ্গে সাক্ষাত করে পরে যে আইনি প্রশ্ন উঠেছে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দেব।’
এ সময় খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত। গতকাল আপনি একটা আদেশ দিয়েছেন। ওই আদেশ পর্যবেক্ষণ করে আমরা দেখেছি তাতে আপনি জানতে চেয়েছেন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিচার চলবে কি না?’
‘এখন কথা হলো তার অনুপস্থিতিতে বিচার চলবে কি না সেটি সিআরপিসিতে বলা আছে। এ বিষয়ে আইনি ব্যাখ্যা আমরা পরে দেব। এখন শুধু এটুকু বলব জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বেগম জিয়াকে আপনিই জামিন দিয়েছেন। আপনার আদেশেই তিনি জামিনে আছেন। যেহেতু তিনি আপনার আদেশেই ভিন্ন একটি মামলায় কারাগারে আছেন। এ মামলায় তিনি আপনার কাস্টডিতেই আছে। এখন তিনি আমাদের কাছে নেই। এ কারণে আমরা আপনার কাছে সাক্ষাতের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছি। আমরা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি।’
‘এছাড়া আপনি নিজেও দেখেছেন তিনি অসুস্থ। ওই দিন তিনি আদালতে এসে আপনার সামনে বলেছেন তিনি অসুস্থ।’
তারপরও বলব ‘অনিচ্ছুক’ শব্দ দ্বারা খালেদা জিয়া এখানে বুঝিয়েছেন, তিনি অসুস্থ। এখানে এসে দীর্ঘসময় বসে থাকার মতো অবস্থা তার নেই।
আইনজীবী মাসুদ আহমেদ বলেন, ‘উনি তো (খালেদা জিয়া) আপনার প্রতি অনাস্থা দেননি। তাহলে তো আবেদন দিয়ে আপনার প্রতি অনাস্থার দাবি করতাম। এটা আমরা বলেনি। আমরা শুধু এখানে আদালত স্থাপন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি। এখানে আদালত স্থাপনের বিষয়টি নিয়ে আমরা প্রধান বিচারপতি কাছে গিয়েছি। প্রধান বিচারপতি দেখবেন বলে আশ্বাসও দিয়েছেন। আসলে অনিচ্ছুক শব্দ দ্বারা মূলত তিনি অসুস্থতার কথা বুঝিয়েছেন।’
এছাড়া বেগম জিয়া যেহেতু আপনার কাস্টডিতে আছে সেই ক্ষেত্রে উনার অনুপস্থিতিতে বিচার চালানোর কোনো সুযোগ নেই বলেও আদালতকে জানান এই আইনজীবী।
তিনি বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া যে অসুস্থ তা প্রমাণিত। কেননা গতকালও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কারাগারে একটা চিঠি এসেছে তাতে তার শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। এ অবস্থায় তার জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হোক এবং আমাদের সাক্ষাতের জন্য অনুমতি দেওয়া হোক।’
এরপর এ মামলার অপর দুই আসামি জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং মনিরুল ইসলাম খানের পক্ষে আইনজীবী আমিনুল ইসলাম আদালতকে বলেন, ‘এ মামলায় চার জন আসামি। এর মধ্যে একজন পলাতক। একজন ভিন্ন মামলায় কারাগারে। আর বাকি দুইজন আদালতে উপস্থিত। এই দুইজনের পক্ষে আমি দাঁড়িয়েছি। যদিও আমরা সকলেই খালেদা জিয়ার প্যানেলভুক্ত আইনজীবী।’
তিনি বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমরা আপনার কাছে একটা মৌলিক আবেদন করেছি। যেখানে আমরা আপনার বিরুদ্ধে কোনো অনাস্থা দেয়নি। আমাদের কথা হলো আগে যেখানে আদালত ছিল। সেটা ছিল উন্মোক্ত। এটি কিন্তু উন্মুক্ত আদালত নয়। এখন বিষয়টি যেহেতু প্রধান বিচারপতির কাছেও গেছে। বিষয়টি পেন্ডিং আছে। তারপরও একটা সিদ্ধান্ত তো আসবে।’
‘এখানে আরেকটা প্রশ্ন উঠেছে, যে একদিকে আদালতকে আমরা অবৈধ বলছি, আবার সেই আদালতে কেন জামিন চাইছি। আমাদের কথা হচ্ছে- কোন বিচারক অবৈধ হলেও তার কাছে গিয়েই আবেদন করতে হয়। এটাই বিধান। আর আমরা তো এই বিচারকের প্রতি অনাস্থা দেয়নি। তাহলে কেন তার কাছে জামিন চাইতে পারব না। এছাড়া আমরা আদালতের কাছে না গিয়ে গাছতলায় গিয়ে তো আর আবেদন করতে পারি না।’
পরের কথা হলো এ মামলার মূল যিনি তার অনুপস্থিতিতে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করা যায় না। এখন যা হচ্ছে সেটা রুটিন ওয়ার্ক। কেননা আইন অনুযায়ী কোরাম না হলে বিচার শুরু করা যাবে না। এ কারনে আমরা জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন করেছি এবং আইনি প্রশ্ন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম স্থগিত চাইছি।
তিনি বলেন, ‘পরের কথা হলো- বেগম জিয়া কেন্দ্রীয় কারাগারে আছে এটা প্রমাণিত। এখন এখানে তার অনুপস্থিততে বিচার চলবে কি না সে বিষয়ে স্পষ্ট আইনি পরামর্শ পরে দেব। এখন যেহেতু খালেদা জিয়ার পক্ষে একটি আবেদন দেওয়া হয়েছে এটা আগে নিষ্পত্তি হোক। তারপর আমরা আমাদের ব্যাখ্যা দেব। আমাদের জবাব সন্তোষজনক হলে আপনি আদেশ দেবেন।’
এ সময় আইনজীবী আমিনুল ইসলামের বক্তব্যের পাল্টা যুক্তি তুলে ধরে দুদকের পক্ষে মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘কী হাস্যকর বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। এখানে আদালতে এসে রুটিন ওয়ার্ক করতে পারবেন, জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে পারবেন কিন্তু যুক্তিতর্ক শুরু করতে পারবেন না। এখানে তিনি দাবি তুলেছেন কোরাম পূর্ণ হয় না। আমার বক্তব্য হলো এখানে কোরাম কীসের। আমরা কি স্টক একচেঞ্জের মিটিং এ বসেছি যে, কোরাম পূর্ণ না হলে কাজ বন্ধ থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা দেখার করার আবেদন করেছেন এটা ভালো কথা। এটা তারা করতেই পারে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হলো- এখানে দুই ধরনের আসামি আছে। তার মধ্যে একজন কারাগারে, দুই জন জামিনে আছেন। এখন যদি খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাদেরও মিলিয়ে ফেলি তাহলে তো সমস্যা। খালেদা জিয়ার দোহাই দিয়ে বাকি দুই আসামির আইনজীবীরা সুযোগ নিতে পারেন না। তারা কেন খালেদা জিয়ার কান্দে চড়ে সুযোগ নেবে।’
যুক্তিতর্ক শুরু না করে জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করতে পারেন না। আদালত যেখানে বসবেন সেটাই আদালত। এ অবস্থায় খালেদা জিয়া আদালতে না এলে তার হাজিরা মওকুফ করে বিচার কাজ চালিয়ে নেওয়ার আবেদন জানান এই আইনজীবী।
ফৌজদারি আইনের ৫৪০ (এ) অনুযায়ী আদালতকে সে ক্ষমতা দেওয়া আছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
কাজল বলেন, ‘খালেদা জিয়া সম্মানিত লোক, তিনি একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। তিনি আইনের মধ্যে থেকেই সকল সুযোগ সুবিধা পাবেন।এটাই আমরা বিশ্বাস করি। তিনি সুস্থ হয়ে আদালতে আসবেন কিন্তু বাকি দুই আসামির তো যুক্তিতর্ক শুরু করা যায়। তারা তো আর অসুস্থ না।’
বেগম জিয়া যদি আসতে না চান, তার আইনজীবীরা যদি সহযোগিতা না করেন। তাহলে আর বিলম্ব না করে এ মামলায় রায়ের জন্য দিন ঠিক করার জন্য আদালতের কাছে আবেদন জানান দুদকের এ আইনজীবী।
এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাসদু আহমেদ তালুকদার বলেন, ‘আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই ৫৪০ এ অনুযায়ী হাজিরা মওকুফের যে কথা উল্লেখ করা আছে সেটি খালেদা জিয়ার জন্য প্রযোজ্য নয়। কেননা তিনি তো আপনার কাস্টডিতে আছেন। তাছাড়া তিনি অসুস্থ সেটি তিনি আদালতে এসে বলে গেছেন। এই কারণে তার বেলায় এ আইন প্রযোজ্য হবে না।’
‘তাছাড়া আমরা তো আপানার বিচার কাজে বাধা সৃষ্টি করছি না। কোনো ধরনের অসহযোগিতা করছি না। এমনটি উদ্দেশ্যও আমাদের নেই। আমাদেরকে সময় দেন আমরা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আপনাকে জানাই।’
পরে আদালত ২০ সেপ্টেম্বর আদেশের দিন ঠিক করেন। ওই দিন পর্যন্ত আসামিরা জামিনে থাকবেন বলেও তিনি জানান।
বিচারিক কাজ সমাপ্তি করেন। ওইদিন পর্যন্ত আসামিরা জামিনে থাকবেন বলেও তিনি জানিয়ে দেন।
রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৪ সেপ্টেম্বর এই কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের ৭ নম্বর কক্ষকে অস্থায়ী আদালত হিসেবে ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়। যদিও খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা দাবি করেন, তারা আদালত স্থানান্তরের কোনো নোটিশ পাননি। সে কারণে ৫ সেপ্টেম্বরের শুনানিতে তারা কারাগারের আদালতে উপস্থিত হননি।
দুর্নীতির এই মামলায় মোট আসামি চার জন। খালেদা জিয়া ছাড়া অভিযুক্ত অন্য তিন আসামি হলেন— খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর তৎকালীন একান্ত সচিব বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।
২০১১ সালের ৮ আগস্ট খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাটি দায়ের করে দুদক। এ মামলায় ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে দুদক।
মামলাটিতে খালেদা জিয়াসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ তৎকালীন বিচারক বাসুদেব রায় অভিযোগ গঠন করেন।
সারাবাংলা/এজেডেক/একে
আরও পড়ুন
খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিচারকাজ চলবে কি না জানা যাবে ২০ সেপ্টেম্বর