Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

O₃’র স্তরকে রক্ষা করার দিন


১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৯:৪৩

।। সারাবাংলা ডেস্ক।।

অক্সিজেন আমাদের জন্য কত জরুরি? ভাবছেন, সকাল সকাল এ আবার কেমন প্রশ্ন? কে না জানে অক্সিজেন ছাড়া প্রাণী বাঁচতে পারে না? হ্যাঁ অক্সিজেন আমাদের এতটাই জরুরি যে আমরা অক্সিজেন শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ না করলে বাঁচতে পারব না। শুধু তাই নয়। এক পরমাণু অক্সিজেন যখন দুই পরমাণু হাইড্রোজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পানির অণু গঠন করে তাও আমাদের বেঁচে থাকার অপরিহার্য বস্তু। অক্সিজেনের আরও একটি অণু আছে, O₃ তিন পরমাণু অক্সিজেন নিজের মধ্যে একটা অণু গঠন করে। এই অণু বেঁচে থাকার আরেক অপরিহার্য বস্তু। এর নাম ওজোন।

বিজ্ঞাপন

বিগত অনেক বছর ধরেই আমরা যখন শুনে আসছি বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, ভূপৃষ্ঠের পানির স্তর বেড়ে যাচ্ছে তার সঙ্গে আরেকটি কথা খুব করে শুনছি তা হচ্ছে ওজনের স্তর ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। আসলে প্রথম দুই সমস্যার কারণ সেই ওজনের স্তর ক্ষয়ই। শুধু মানুষ নয়, এই পৃথিবীর সব প্রাণী অস্তিত্বের সঙ্গেই এখন জড়িয়ে আছে ওজনের স্তর।

আমরা যে গ্রহে বাস করি তা বাসযোগ্য হওয়ার একটি মাত্র কারণ বায়ুমণ্ডল। বলতে পারেন এটাই আমাদের প্রাণ ভোমরা। শুধু মাত্র এই বায়ুমণ্ডল নেই বলে মানুষ সৌরজগতের বিশাল সব গ্রহে বসবাস করতে পারছে না। আর বায়ুমণ্ডলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে ওজোন স্তর। ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ২০-৩০ কিলোমিটার উপরে থাকা এই স্তরটির একটা বিশাল কাজ আছে। এটি সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনী রশ্মির একটা বিশাল অংশ শোষণ করে নেয়। ক্ষুদ্র তরঙ দৈর্ঘ্যের এই রশ্মি প্রাণীর দেহে ক্যান্সারের সূত্রপাত করে। এবার বোঝা গেলো তো কেন ওজোন এত জরুরি?

ওজোন স্তর, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ

ওজোন নিয়ে গবেষণা হচ্ছে বেশ অনেক আগে থেকেই। সেই কোন ১৯৩০ সালে ফরাসী পদার্থবিদ চার্লস ফ্যব্রি এবং হেনরি বুইসন ওজোন স্তর আবিষ্কার করেন। এরপর ব্রিটিশ আবহাওয়াবিদ জি এম বি ডবসন ওজোনস্তর নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ১৯২৮ সাল থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে তিনি ওজোন পর্যবেক্ষণ স্টেশনসমূহের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। এরপরেই সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনাটা ঘটে।

বিজ্ঞাপন

১৯৭০ সালে বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন পৃথিবীর ওজোনস্তরে ক্ষয় হচ্ছে। ক্ষয়ের পরিমাণ নেহায়েত কমও নয়। প্রতি বছর ওজোনস্তর তার আয়তনের ৪% হ্রাস পাচ্ছে। এই ভয়ানক ঘটনা যখন বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন তখনও তার ভয়াবহতা নিরূপণ বাকি ছিল। এই ক্ষয় যে কোনো জায়গায় নয় একদম মেরু অঞ্চলগুলোতেই হচ্ছে। অর্থাৎ যেখানে বরফ আবৃত। এখানে ওজনের ক্ষয় মানে তাপমাত্রা বৃদ্ধিও। আর তাপ বাড়লে বরফ গলে যাবে, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও বেড়ে যাবে।

বিজ্ঞানীরা ওজোনস্তরকে আগের অবস্থায় নিতে নানান বুদ্ধি বের করা শুরু করলেন। তার মধ্যে কিছু হাস্যকর শিশুতোষ বুদ্ধিও ছিল। যেমন, বড় প্লেনে করে ওজোন গ্যাস নিয়ে গিয়ে ফুটো হওয়া স্তরে ছেড়ে আসা। কিন্তু এসব পরামর্শ তাত্ত্বিকভাবে কার্যকর শোনালেও আদতে কোনো কাজে আসে না। এই যে এতগুলো প্লেন যাবে ওজোন নিয়ে তারা চলতে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি করবে সেগুলো বুঝি কোনো প্রভাব ফেলবে না? সেই তো হিসেব করে একই দাঁড়ায় ঘটনাটি, মধ্যে থেকে শুধু অনেকগুলো টাকার শ্রাদ্ধ হতো!

যাক বিজ্ঞানীরা এরপর আস্তে আস্তে গবেষণা শুরু করেন। তারা জানতে পারেন ওজোন স্তর ক্ষয়ের জন্য দায়ী বিশেষ কিছু গ্যাস। কে সেই খলনায়ক গ্যাস? পাওয়া যায় হ্যালোজেন অণুকে। এরপরের প্রশ্ন হচ্ছে কোথা থেকে আসছে এসব হ্যালোজেন অণু? এই প্রশ্নের জবাবে সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। এই হ্যালোজেন অণুর মূল উৎস হল মানবসৃষ্ট হ্যালোকার্বণ হিমায়ন পদার্থের সালোক বিভাজন। যেমন: ক্লোরোফ্লুরোকার্বন, ফ্রেয়ন, হ্যালোয়াঅ্যালকেন ইত্যাদি। ভূপৃষ্ঠ থেকে নির্গমনের পর এই সকল যৌগ স্ট্র্যাটোমণ্ডলে গিয়ে পৌঁছে।

হ্যালোজেনের এইসব অণুর খুব সাধারণ উদাহরণ হচ্ছে ক্লোরোফ্লুরোকার্বন। আর এগুলো থাকে আমাদের হাতে হাতেই। ডিওড্রেন্ট বডি স্প্রের বোতল, ফ্রিজের কম্প্রেসারের থাকা গ্যাস, এসির গ্যাস। এগুলো থেকেই তৈরি হয় CFC বা ক্লোরোফ্লুরোকার্বন যা বাতাসে মুক্ত হয়ে ওজনের O₃ অণুকে ভেঙ্গে অন্য একটি যৌগ গঠন করে।

বিজ্ঞানীরা এই তথ্য জানার পরে সবচেয়ে বড় যে সমস্যায় পড়লেন তা হচ্ছে জনে জনে বোঝানো যে এই এভাবে ওজোনস্তর ক্ষয় হচ্ছে। তারচেয়েও বড় কথা ততদিনে শিল্প বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় সবাই অনেক বেশি ভোগী হয়ে গেছে। নতুন নতুন শিল্প কারখানা হচ্ছে বড় বড় কোল্ড স্টোরেজ হচ্ছে, কে কাকে বাঁধা দিবে?

এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন বিশ্ব নেতারা। ১৯৮৫ সালের ২২ মার্চ বিশ্ব নেতারা ওজনের এই সমস্যা নিয়ে মিলিত হন অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে। সেখানে ১৯৭টি দেশের প্রতিনিধিরা এই সিদ্ধান্তে আসেন যে এই ওজোন স্তর বাঁচাতে আমাদের কিছু করতে হবে। এরপর শুরু হয় কর্মপন্থা নির্ধারণ। বিজ্ঞানীরা জানান, আমরা যদি ওজোন স্তরের ফুটো ভরাট না করতে পারি আমরা অন্তত এমন কিছু করতে পারি যেন ওজোন স্তরে নতুন করে ক্ষয় না হয়। সেই লক্ষ্যে ১৯৮৭ সালের ১৪ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর কানাডার মন্ট্রিয়ালে আবার বিশ্ব নেতারা একত্রিত হন। তারা ঠিক করেন যেভাবেই হোক ওজোনস্তর ক্ষয়কারী এসব হ্যালোজেন গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে দিতে হবে। শুরু হয় বিকল্প পন্থা খোঁজা।

ওজোন স্তর, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ

ওদিকে যেহেতু সারা পৃথিবীর মানুষকেও জানাতে হবে ওজোনস্তর ক্ষয়ের বিষয়ে তাই একটা দিন ঠিক করে দেওয়া হয় ওজোন দিবস নামে। ১৬ সেপ্টেম্বর হচ্ছে সেই দিন।

প্রায় ৩০ বছর আগে হওয়া এই চুক্তি পৃথিবীর অন্য সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও স্বাক্ষর করেছিল। সে হিসেবে বাংলাদেশের নাগরিক আমরা সবাই এই চুক্তির অংশীদার। আর পৃথিবীর মানুষ হিসেবে পৃথিবী রক্ষার দায় তো আমাদের আছেই। সে কথা যেন আমরা ভুলে না যাই তাই আজকের দিনে আবার মনে করে দেয়া, এই পৃথিবীকে আমাদের রক্ষা করতে হবেই। তাই ওজোনস্তরকে আর ক্ষয় করা যাবে না।

এখানে ভালো খবর হচ্ছে পৃথিবীর মানুষ যখন উদ্যোগ নিয়ে হ্যালোজেন গ্যাস ব্যবহার কমিয়ে এনেছে তখন ওজোন স্তর নিজেই নিজেকে পূরণ করা শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু এখনও আমাদের উপর থেকে বিপদ কমেনি। আর কমেনি বলেই আজকের দিনটি এত গুরুত্বপূর্ণ।

এ বছর বিশ্ব ওজোন দিবসের মূল প্রতিপাদ্য খুব সহজ, Keep Cool and Carry On: The Montreal Protocol অর্থাৎ শান্তভাবে মন্ট্রিয়াল চুক্তি পালন করে যাও। কারণ আমাদের আরও অনেকটা পথ পার হতে হবে।

এই চুক্তি পালনের জন্য জাতিসংঘ বেশ মজার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে মোবাইল অ্যাপ পর্যন্ত আছে যাতে যানা যাবে ওজোন স্তরের কী অবস্থা অথবা কীভাবে এই ক্ষয় পূরণ হবে। আজকের দিনটিতে নানানভাবে ওজোন সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা হবে। আমরা যারা ইতিমধ্যে দিনটি সম্পর্কে অনেক জেনে ফেলেছি তাদের কাজ হচ্ছে অন্যদের এ সম্পর্কে সচেতন করা এবং ওজোনস্তরকে রক্ষা করার কাজে সহায়তা করা। কারণ, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য পৃথিবীটার ভালো থাকাও খুব জরুরি।

সারাবাংলা/এমএ/এনএইচ

ওজোন স্তর জলবায়ু পরিবর্তন পরিবেশ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর