টিআইবিকে ‘কড়া জবাব’ দেবে পুলিশ
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:২৮
।। উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: দেশে দুর্নীতিগ্রস্ত শীর্ষ খাত হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোকে চিহ্নিত করে গত ৩০ আগস্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন জানানো হয়, দেশের ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার মাধ্যমে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। আর ৬০ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ ঘুষের শিকার হয়েছেন।
টিআইবির প্রতিবেদন মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ছাড়াও সেবাখাতে দুর্নীতিতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয় যথাক্রমে পাসপোর্ট ও বিআরটিএ সেবা খাত।
টিআইবির প্রতিবেদনের পর পুলিশ সদর দফতর থেকে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও কড়া জবাব দেওয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। প্রস্তুতির জন্য পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। বর্তমানে ওই কমিটি কাজ করছে।
কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘টিআইবিকে জবাব দেওয়ার জন্য প্রতিবেদন তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। প্রতিবেদনটি কয়েকদিনের মধ্যেই পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারির কাছে জমা দেওয়া হবে। প্রতিবেদনে টিআইবির জরিপের ত্রুটি-বিচ্যুতিও তুলে ধরা হয়েছে। তাদের করা প্রতিবেদনে পুলিশকে এক তরফাভাবে দোষারোপ করা হয়েছে।
জরিপের কাজের সময় তথ্যদাতা কোন শ্রেণি-পেশার এবং তারা কোন মতাদর্শের তা উল্লেখ করা হয়নি। ফলে ধারণা করা হচ্ছে যে, প্রতিবেদনটি ছিল একপেশে এবং অনেকটা ঘরে বসে করার মতো। সবমিলিয়ে টিআইবির প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে পুলিশের ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়েছে।
আরও পড়ুন: শীর্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার দুর্নীতি: টিআইবি
প্রতিবেদনে কী রয়েছে জানতে চাইলে ডিএমপির একজন উপকমিশনার নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘থানায় জিডি করতে টাকা লাগে না। মামলা করতে টাকা লাগে না। মানুষ হয়রানির শিকার হবে না এমন ব্যবস্থা পুলিশ নিয়েছে। এরপরেও কে বা কারা পুলিশের কাছ থেকে দুর্নীতির শিকার হয়েছে, সেটা বুঝতে পারছি না। ভুক্তভোগীরা কারও কাছে বললেন না, টিআইবির কাছেই সবাই বললেন।’
পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘প্রতিবেদন প্রকাশের পর আশা করি তারা আনুষ্ঠানিক না হলেও অফিসিয়ালি জরিপটি প্রত্যাহার করে নেবেন।’
পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘টিআইবিতেও দুর্নীতি হয়। তারা ১০ টাকার অনুষ্ঠান করলে বিল দেখান এক হাজার টাকার। কাজেই তারা আবার কীসের দুর্নীতির জরিপ করবেন।’
একটি প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বিআরটিএতে কী হচ্ছে তা সবাই জানে। অথচ সেখানে দুর্নীতির শিকার দেখিয়েছে টিআইবি ৬৫ দশমিক ৪ শতাংশ। যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার হাতে শিকার হয়েছেন ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। এতেই বোঝা যায় টিআইবির জরিপের স্বচ্ছতা ও যৌক্তিকতা কতটুকু?’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা হিসেবে পুলিশ আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে জানিয়ে পুলিশ সদর দফতরের একজন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) সারাবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশে আমূল পরিবর্তন এসেছে। কেউ অপরাধ করলে তার শাস্তি হচ্ছে। বিগত সরকারগুলোর আমলে দুর্নীতি প্রবেশ করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বেতন ভাতা বৃদ্ধি পাওয়ায় দুর্নীতি বিদায় নিয়েছে। পুলিশ এখন স্বচ্ছ এক বাহিনীর নাম। লাখ লাখ সদস্যর মধ্যে দু একজন দুষ্টু মানুষ থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এরপরেও টিআইবি যে প্রতিবেদন দিয়েছে তা মেনে নেওয়া যায় না। ভালোকে ভালো বলতে হবে। না হলে ভালোটাও হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘টিআইবি স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি অনুসরণ করে জরিপ করে থাকে। অন্যান্যবার যেসব নিয়ম মেনে জরিপ করা হয় এবারও সেভাবেই জরিপ করা হয়েছে।’
জরিপে তথ্য দাতাতের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কাছে এক হাজার ৪৮ জন সেবা নিয়েছেন। এর মধ্যে নারী ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ ও পুরুষ ৮৬ দশমিক ৩ শতাংশ। যেখানে দুর্নীতির শিকার হয়েছে নারী ৭১ দশমিক ৪ শতাংশ ও পুরুষ ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ। সেবা গ্রহণকারীর বয়স ১৮ বছর থেকে ৬৫ বছর পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। তবে সেবা গ্রহণকারীরা কোন পেশার এবং কোন রাজনৈতিক মতাদর্শের তা জরিপে উল্লেখ করা হয়নি। টিআইবি জরিপের সময় রাজনৈতিক মতাদর্শ বিবেচনায় আনে না। কারণ এতে জরিপ ভিন্নখাতে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আলাদা রাজনৈতিক জরিপ হতে পারে, তবে সেবাখাতে নয়।’
এদিকে টিআইবির প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।
প্রতিবাদে বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত দুই লক্ষাধিক সদস্য ১৬ কোটিরও বেশি জনগণের শান্তি, নিরাপত্তা এবং জন-শৃঙ্খলা নিশ্চিতকল্পে দিনরাত্রি নিরবচ্ছিন্নভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। ১৯৭১ সালের প্রথম প্রহরে রাজারবাগ থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম বুলেট ছুড়েছিল পুলিশের অকুতোভয় সদস্যরা। সমসাময়িক সময়ে যুদ্ধাপরাধীর বিচার, জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে সাফল্য, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও চাঞ্চল্যকর মামলার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত থেকে শুরু করে বিভিন্ন উৎসব ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টে বাংলাদেশ পুলিশ নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছে, যা রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। সেক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনীর মতো রাষ্ট্রের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান তদন্তকারী সংস্থাকে মুষ্টিমেয় কতিপয় লোকের মতামতের ভিত্তিতে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত।
পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিবাদে বলা হয়, এই জরিপে যারা মতামত দিয়েছেন তাদের মধ্যে কতজন বা আদৌও কেউ প্রত্যক্ষভাবে উল্লিখিত সময়ে পুলিশি সেবা নিতে গিয়েছিলেন কি-না তাও স্পষ্ট নয়। ফলে এরূপ একটি প্রতিবেদন শুধু শ্রুতিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তাই টিআইবির প্রতিবেদনটি পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন প্রত্যাখ্যান করছে।
সারাবাংলা/ইউজে/একে
জরিপ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বাংলাদেশ পুলিশ সেবা খাত