ভালো নেই বার্ন ইউনিটের কর্মচারীরা
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:৪৭
।। সোহেল রানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ভালো নেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বার্ন ইউনিটের কর্মীরা। দুঃসহ যন্ত্রণায় কাতর রোগীদের সেবা দিয়ে আজ বার্ন ইউনিটের কর্মচারীরাই মনে ক্ষত নিয়ে দিনযাপন করছেন। অনিয়মিত কর্মচারীরা জানান, বিগত ১৫ বছর ধরে বিনা বেতনে রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ আজ পর্যন্ত তারা কোনো বেতন পাননি, স্থায়ী হয়নি তাদের চাকরিও।
অনিয়মিত কর্মচারী কল্যাণ সমিতি নেতারা অভিযোগ করে বলছেন, ‘দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, এখন আর কোনো উপায় নাই। যেকোনো দিন কর্মবিরতিতে চলে যেতে পারেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বার্ন ইউনিটের অনিয়মিত কর্মচারীরা।’
সমিতির সভাপতি জীবন মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক হাবিল মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দাবি যারা দীর্ঘদিন ধরে বার্ন ইউনিটে কাজ করছে, তাদের চাকরি আগে স্থায়ী হোক, পরে অন্যদেরটা।’
জীবন মিয়া বলেন, ‘বার্ন ইউনিটে ৬৮ জন অনিয়মিত শ্রমিক আছেন। এদের মধ্যে অনেকেই এখানে কাজ করতে করতে যৌবন পার করে দিয়েছেন, শুধু চাকরিটা স্থায়ী হবে ভেবে। আর এখন যদি বয়সের বাহানা দেখিয়ে তাদের বাদ দেওয়া হয় তাহলে কি অবস্থা হবে? তাদেরকে নিশ্চয়ই চুরি-ডাকাতির পথ বেছে নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন আগে আমরা নিজেদের মধ্যে মিটিং করেছি। পরে বার্ন ইউনিটের বিভাগীয় প্রধানদের সাথে মিটিং করেছি। তারা আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। সেই আশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে আমরা এখন দিন গুণছি।’
১৯৮৭ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৩ সালে ১০ জন চিকিৎসক নিয়ে ৫০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ ইউনিট যাত্রা শুরু করে। ২০০৯ সালে তা ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। এরপর দিন দিন এই ইউনিটের কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়।
পরে ২০১৩ সালে বার্ন ইউনিটকে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব প্লাস্টিক সার্জারি নামে রূপান্তরিত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি আদেশ জারি হয়। কার্যক্রমের পর থেকে প্রতিদিনই বাড়ছে এই ইন্সটিটিউটের কার্যক্রম। পোড়া রোগীর চিকিৎসার পাশাপাশি বাড়ছে তাদের কাজের পরিধিও।
আগুন, এসিড, এবং যেকোনো ধরনের বিস্ফোরণে দগ্ধ রোগীরা ছুটে আসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। চিকিৎসকদের কাছে পৌঁছার আগেই তাদের পাশে দাঁড়ান ইউনিটের অনিয়মিত কর্মচারীরা। এরপর রোগীর দগ্ধ জায়গা পরিষ্কার করে পাঠানো হয় চিকিৎসকদের কাছে।
অনিয়মিত কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাবিল মিয়া বলেন, ‘বার্ন ইউনিটে ৬৮ কর্মচারীর মধ্যে কেউ হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিছন্ন থেকে শুরু করে অপারেশন থিয়েটার এইচডিইউ, আইসিইউ, অফিস, চিকিৎসকদের রুমে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আবার কেউ ওয়ার্ড বয়, এমএলএসএস, ইলেকট্রিশিয়ান, ড্রেসার কেউ অটোকেভ অপারেটর হিসাবে কাজ করছেন। এদের মধ্যে কেউ ১৫ বছর কেউ ১০ বছর ধরে বিনা বেতনে কাজ করে যাচ্ছেন।’
জানা যায়, এই দীর্ঘ সময়ে অনেকেই তাদের চাকরি স্থায়ীকরণের আশ্বাস দিলেও বাস্তবায়ন করেনি কেউ। বর্তমানে যখন তাদের চাকরি স্থায়ীকরণের সুযোগ আসতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই একটি পক্ষ বয়সের দোহাই দিয়ে বাদ দিতে চাইছে বলে অভিযোগ করছেন ১৫ বছর বিনা বেতনে কাজ করা কর্মচারীরা। এতে করে চরম হতাশায় পড়েছেন বার্ন ইউনিটে কাজ করা ৬৮ কর্মচারী। এদের মধ্যে নারী রয়েছেন ১৫ জন।
২০১৫ সালে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েকজন কর্মকর্তার চাকরি স্থায়ী করা হয়। ওই সময় মাস্টাররোল দেখিয়ে চতুর্থ শ্রেণির এই কর্মচারীদেরও প্রকল্পের আওতায় এনে তিন মাসের বেতন দেওয়া হয়েছিলো। তিন মাস বেতন পাওয়ার পর চতুর্থ শ্রেণির এই কর্মচারীদের আর কোনো বেতন দেওয়া হয়নি।
এই ঘটনার আগে ও পরে এখন পর্যন্ত কেউ হাসপাতালের পক্ষ থেকে একটি পয়সাও পাননি। যার কারণে প্রতিটি কর্মচারীকে চরম মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। হতাশায় বুদ হয়ে যখন ইউনিটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে যান তখন তারা নানা ধরনের আশ্বাস দিতে থাকেন। কিন্তু সেগুলো আর বাস্তবায়ন হয় না।
কর্মচারীদের অনেকেই বলছেন, ‘শেখ হাসিনা ন্যাশনাল বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারিতে কাজ শুরু হলে সরকারিভাবে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ করা হবে। এক্ষেত্রে ১৫ বছর ধরে বিনা বেতনে সেবা দিয়ে যাওয়া কর্মচারীদের অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। কিন্তু একটি স্বার্থান্বেষী মহল বয়সের দোহায় দিয়ে এই কর্মচারীদের বাদ দিয়ে টাকার বিনিময়ে অন্যদের নিয়োগ দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে।’
কর্মচারীরা তাই মানবিক দিক বিবেচনা করে বিনা বেতনে চাকরি করা ৬৮ জন কর্মচারীর চাকরী স্থায়ী করার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
মিরপুর থেকে রোগী নিয়ে আসা আসলাম শিকদার বলেন, ‘গত ১৪ সেপ্টেম্বর তার ভাতিজাকে নিয়ে বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন। দেখলাম চিকিৎসকদের কাছ থেকে যে সেবা পাচ্ছি, তার চাইতে বেশী সেবা দিচ্ছেন কর্মচারীরা। তার বিনিময়ে তাদেরকে টাকাও দিতে হচ্ছে। শুনেছি বার্ন ইউনিটে যারা কাজ করছে সবাই অনিয়মিত। তাই তারা আমাদের কাছে টাকা দানি করছে। তারা বলছে, তারা বেতন পান না।’
বার্ন ইউনিটের কয়েকজন চিকিৎসক বলেন, ‘বার্ন ইউনিটে অনিয়মিত কর্মচারীই বেশি। এক বছর, দুই বছর হলেও হয়; ১৫ বছর ধরে এরা বার্ন ইউনিটে বেতন ছাড়া খেটে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যেই দেখি তাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ। বেতন-ভাতা না পেলে তাদের অনিয়ম করা স্বাভাবিক।’
বার্ন ইউনিটের ছয় তলার কেবিনে কাজ করা অনিয়মিত কর্মচারী মৌসুমী আক্তার বলেন, ‘দীর্ঘদিন যাবৎ কেবিনে কাজ করছি। আবুল বাজানদার, মুক্তামনি, ও নেপালে দুর্ঘটনার অনেক রোগীরই কাজ করেছি। সাধারণ রোগীদের কাছ থেকে কিছু টাকা বকশিস পেলেও। এদের কাছ থেকে কিছু পাইনি। শুধু চাকরিটা স্থায়ী হবে ভেবে এখনও আশায় আছি।’
বার্ন ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ খন্দকার বলেন, ‘বার্ন ইউনিটে যারা আছেন তারা দীর্ঘদিন বিনা বেতনে রোগীদের সেবা দিয়ে আসছেন। তারা কাজ না করলে রোগীদের সেবা দেওয়া যেত না। তাই আমি সব চিকিৎসক ও কর্মকর্তাদের নিয়ে তাদের জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানাবো ওদের যেন একটা ব্যবস্থা করা হয়।’
সারাবাংলা/এসএসআর/এমও
ঢামেক ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বার্ন ইউনিট