রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়ছে চর্মরোগের ঝুঁকি
৬ অক্টোবর ২০১৮ ০৮:২৫
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
কক্সবাজার থেকে ফিরে: মায়ের হাত ধরে হেলথ কেয়ার সেন্টারে এসেছে সাড়ে তিন বছরের রোখসানা। রোখসানার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে মায়ের পেছনে গিয়ে আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকে সে। কথা হয় রোখসানার মা উম্মুলের সঙ্গে। তিনি জানান, রোখসানার হাত-পায়ে ঘায়ের মতো হয়েছে। পুরো শরীর চুলকায় আর রক্ত বের হয়। একই অবস্থা তার নিজেরও, পুরো শরীরে দাউদ। তাই মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই এসেছেন চিকিৎসকের কাছে।
কেবল রোখসানা কিংবা উম্মুল নন, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে শুরু থেকে চর্মরোগের ঝুঁকিতে রয়েছেন প্রতিটি ব্যক্তি। অনিরাপদ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বিশুদ্ধ পানির অভাব, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং সচেতনতার অভাবে তারা চর্মরোগে ভুগছেন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের কুতুপালং লাম্বাসিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠিত পিএইচসি (প্রাইমারি হেলথ কেয়ার) সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে নারী এবং শিশুরা এসেছেন চিকিৎসা নিতে। তাদের মধ্যে গর্ভবতী নারী এবং চর্মরোগে আক্রান্ত নারী ও শিশুর সংখ্যাই শতকরা ৯০ ভাগ। প্রাইমারি হেলথ কেয়ারে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানালেন, নিজ দেশে তারা স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়েই ছিলেন। এসব বিষয়ে তারা একেবারেই অজ্ঞ। অসচেতনতার কারণে এখানে আসার পরও তারা চর্মরোগের ঝুঁকিতে রয়েছে।
চিকিৎসকরা আরও জানালেন, প্রায় এক বছর থেকে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছি আমরা। এখন অনেকটা উন্নতি হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা নিতে তারা নিজে থেকে খুব কম আসে। এখানে এলে তাদের সচেতনা বিষয়ে ধারণা দেওয়া হয়। এছাড়া ক্যাম্পে গিয়েও তাদের বোঝানো হয়।
পিএইচসিতে কর্মরত চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কক্সবাজারের কুতুপালং, উখিয়া, বালুখালি, হলুদিয়া পালং, হাকিমপাড়া, মধুরছড়া,পালংখালির রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের ১১টি পিএইচসি ( প্রাইমারি হেলথ কেয়ার) রয়েছে। সেখানে নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি চলছে। দেওয়া হচ্ছে চর্মরোগ, গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসা সেবা।
গত এক বছর ধরে কুতুপালংয়ের লাম্বাসিয়া ক্যাম্পে পিএইচসি সেন্টারে মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে কাজ করছেন মো. আরিফুর রহমান। সারাবাংলাকে তিনি জানালেন, মিয়ানমারে থাকতে রোগ প্রতিরোধে টিকা নেওয়ার বিষয়ে তারা কিছু জানতো না। এখানে আসার পরে তাদের এসব কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে। প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ এখন প্রাথমিকভাবে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় এসেছে- আমরা বলতে পারি। এক বছর আগেও তারা হাইজিন সর্ম্পকে জানতো না। টয়লেট থেকে আসার পরে, ভাত খাবার আগে হাত ধুতে হবে- এই সচেতনতাও তাদের ভেতরে ছিল না। প্রথম দিকে আমরা যখন কথাগুলো বলতাম, তখন তারা হাসাহাসি করতো। এখন অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে।
পিএইচসি সেন্টারগুলোতে ১৩ থেকে ১৪ জন করে কর্মী মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন। তারা প্রতিদিন এসব ক্যাম্পে যান, সবার সঙ্গে বসে আলোচনা করেন। সেখানে হাইজিন, টিকাদান সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। হেলথ সেন্টারগুলোতে তারা যখন আসেন, প্যারাকাউন্সিলদের কাছে যান, তখন সেখানেও প্রতিটি কর্মী পর্যাপ্ত সময় দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন। এই ফিডব্যাকটা আমরা এখন পাচ্ছি। এমনও হয়েছে টিকা দেওয়ার কথা বলায় ক্যাম্প থেকে চলে গেছে অনেকে। আমাদের বলেছে, ‘তোমরা আমার বাচ্চাদের মেরে ফেলতে চাইছো’ অথবা ‘আমার মেয়ে শিশু যেন কখনও মা হতে না পারে সেজন্য টিকা দেওয়া হচ্ছে’। এখনও চর্মরোগ ক্যাম্পগুলোতে বড় সমস্যা। আর বাড়ছে পেপটিক আলসার। এর কারণ, অপরিচ্ছন্নতা। দিনের পর দিন তারা গোসল করে না। সরকারের পক্ষ থেকে এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকে তাদের সাবান দেওয়া হয়, সেগুলো তারা স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করে দেয়- বলেন আরিফুল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন চিকিৎসক বলেন, এখানে কাজ করতে এসে মনে হচ্ছে, মিয়ানমারে আজকের সমাজটাকে ওরা দেখতে পায়নি। প্রথমে তাদের সহযোগিতাও পেতাম না। তাদের কিছু বোঝালেও বুঝতো না। এরা এখানে ছোট ছোট কুঁড়ে ঘরে থাকে। মাটিতে বা মেঝেতে থাকে। দেখা যায়, বাচ্চা পায়খানা করে রেখেছে, কোনো রকম সরিয়ে দিয়ে সেখানেই হয়তো ভাতের থালা নিয়ে বসে গেল।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপিং মিডওয়াইভস প্রোজেক্টের ম্যানেজার (কক্সবাজার অ্যাকাডেমিক সাইট) ইয়াসমিন আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রচুর সাবান, ট্রুথ ব্রাশ, জিটারজেন্ট, স্যাভলন দেওয়া হয়। কিন্তু তারা ব্যবহার করে না। সেগুলো ছোট ছোট টুকরিতে করে বিক্রি করে দেয় কম দামে। রাস্তার পাশে থাকা এসব প্রডাক্ট কম দামে পাওয়াতে অনেকেই সেখান থেকে কিনেও নেয়।
ডা. তাপস ধর কক্সবাজারে আছেন প্রায় এক মাসের মতো। লাম্বাসিয়াতে ব্র্যাকের প্রাইমারি হেলথ কেয়ারে কাজ করছেন। তিনি জানালেন, লাম্বাসিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোগীর সংখ্যা একটু বেশি বলেই মনে হয়। প্রতিদিন প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জনের মতো রোগী দেখছেন তারা। যেভাবে তারা বাস করে, তাতে চর্মরোগ হওয়ার প্রবণতা খুব বেশি। কারণ এটি ছোঁয়াচে রোগ। গত বছরেও চর্মরোগের প্রকোপ এখানে বেশি ছিল। এখানকার প্রতিটি ঘরে দাউদ আক্রান্ত রোগী রয়েছে। তাদের চিকিৎসায় যে মলম দেওয়া হয়, সেটা সাধারণত ১৪ দিন লাগানোর নিয়ম। কিন্তু একটু কমে গেলেই তারা মলম ব্যবহার করা ছেড়ে দেয়। আবার দেখা যায়, ঘরে একজন ব্যবহার করছেন কিন্তু বাকিরা করছেন না। ফলে নির্মূল হচ্ছে না। তাদের কাউন্সিলিং দিচ্ছি আমরা-কাজ হচ্ছে না। পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ, তারা গোসল করছে না। জামা-কাপড় ধোয়ার বিষয়টি অনেক পরের বিষয়।
ডা. তাপস বলেন, খাদ্যাভ্যাসের কারণে তাদের পেপটিক আলসার হচ্ছে। এরা প্রচুর পরিমাণে তেল-মসলা-মরিচ খায়। তাদের লাইফ স্টাইল মোডিফাই করা জরুরি। সবাই খাবার পাচ্ছে, কিন্তু কতটা পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে তাতে সন্দেহ আছে। দেখা যায় ওদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবেই কম। যে কারণে ডায়রিয়ায় ভোগা রোগীর সংখ্যাও কম না। যদিও এক বছর আগের চেয়ে ওরা এখন অনেক ভালো আছে, সচেতনতা বেড়েছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চর্মরোগের ঝুঁকি বেশি- বললেন কক্সবাজার জেলার সিভিল সার্জন মো. আব্দুস সালাম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, এখানে চর্মরোগীর অনেক। ঘনবসতির কারণে এক জনের হলে দ্রুত এই রোগ ছড়িয়ে পরে। আমাদের পক্ষ থেকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ‘পার্সোনাল হাইজিন’ তারা মেইনটেইন করতে পারছে না। কিছুদিন আগ পর্যন্ত বিশুদ্ধ পানির অভাব ছিল। তখন শিশুরা নোংরা পানিতে গোসল করতো। প্রথমে শিশুরা আক্রান্ত হতো, পরে পরিবারের বাকিরা। তবে এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সবকিছু। সবচেয়ে বড় বিষয় ওরা সচেতন না, যে কারণে চিকিৎসার আওতায় আনতেও বেগ পেতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। তবে পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধ আমাদের রয়েছে, আশা করি সবাইকে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে।
সারাবাংলা/এটি