গয়না-জমি বিক্রি করে ক্যান্সার-যুদ্ধে জয়ী শিশু দিপীর গল্প
৮ অক্টোবর ২০১৮ ০৮:১৯
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ছয় বছর আগের কথা। হঠাৎ প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত দুই বছর আট মাসের শিশু জেবা তাসহীন দিপী। স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েও জ্বর কমেনি তার। দেখতে দেখতে দিপীর শরীরে ছড়িয়ে পড়ে দাগ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ধরা পড়ে লিউকোমিয়া। চিকিৎসকরা জানান, ভারতে নিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। খরচ হবে ৩০ লাখ টাকা। স্বল্প আয়ের পরিবারের মাথায় তখন বাজ। শেষ পর্যন্ত তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ৩০ লাখ টাকা খরচ না হলেও দিপীর চিকিৎসায় শেষ পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে তার মায়ের গয়না, বাবার জমি। টানা তিন বছরের দীর্ঘ চিকিৎসায় গোটা পরিবারকেই বয়ে বেড়াতে হয়েছে অবর্ণনীয় কষ্ট আর দুর্ভোগ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্যান্সারের সঙ্গে সেই যুদ্ধে জয়ী হয়েছে দিপী। আর সে কারণেই এখন দিপী আর বাবা-মায়ের মুখে ফুটেছে হাসি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আয়োজিত হয়েছিল ক্যান্সারকে পরাজিত করে জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়া শিশুদের এক মিলন মেলা। হাসপাতালের শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এ কে এম আমিরুল মোরশেদ খসরুর উদ্যোগে ক্যান্সার সচেতনতা মাস উপলক্ষ্যে এই আয়োজনেই যোগ দিতে এসেছিল শিশু দিপী আর তার মা তাওহীদা হক। সেখানেই কথা হয় তার সঙ্গে।
ক্যান্সারজয়ী শিশুদের মিলনমেলায় মেয়ে দিপীকে জড়িয়ে বসেছিলেন তার মা সিরাজগঞ্জের একটি সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক তাওহীদা হক। সেখানে একে একে মায়েরা তুলে ধরছিলেন সন্তানের ক্যান্সার-যুদ্ধের কথা। শুনছিলেন আর যেন আরও জোরে বুকে জড়িয়ে ধরছিলেন মেয়েকে। কখনও তার চোখ ভিজে যায় জলে, কখনও প্রত্যয় ফুটে ওঠে তার চোখে।
গিয়ে পাশে বসি। কথা বলতে বলতে তিনি বলেন মেয়েকে নিয়ে তার নিজের যুদ্ধের কথা। সরকারি চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে মেয়েকে নিয়ে দিনের পর দিন হাসপাতালে কাটিয়েছেন, নিজের বিয়েতে পাওয়া একটুখানি সোনার গয়না বিক্রি করে কিনেছেন মেয়ের ওষুধ। সামান্য কিছু জমি ছিল, বিক্রি করে দিতে হয়েছে তাও। তবে সব কষ্ট পরিণত হয়েছে আনন্দে, যখন কলিজার টুকরা মেয়েটি জিতে গেছে ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধে। মেয়ের গল্প বলেন আর কাঁদেন তাওহীদা। সেই কান্নার পুরোটাই আর বেদনা নয়। যুদ্ধ জয়ের গৌরবও আছে। তারচেয়েও বড় গর্ব, তাওহীদা থেকে এখন তিনি ‘দিপীর মা’।
মেয়ের অসুখ কেমন করে ধরা পড়লো, জানতে চাইলে তাওহীদা বলেন, তখন দিপীর বয় দুই বছর আট মাস। খুব জ্বর ছিল। স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে যাবার পর অ্যান্টিবায়োটিক দেন চিকিৎসক। কয়েকদিন ওষুধ খেয়েও জ্বর কমে না। হয়তো দুই থেকে তিন ঘণ্টা জ্বর নেই, কিন্তু আবার সেই জ্বর। এত জ্বর যে মেয়েটার কপালে হাত দেওয়া যায় না। মেয়েটা প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। শরীরেও বিভিন্ন জায়গায় দাগ।
তাওহীদা বলেন, আমি একদিন স্কুলে, মা ফোন করে তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে বলেন। দৌড়ে বাড়ি যাই। এসে দেখি, মেয়ের প্রস্রাবের রাস্তার দুই পাশেও সেই জখমের মতো দাগ। ওর বাবাকে ফোন দিলাম। আসার পর সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালে এক নামকরা চিকিৎসকের কাছে গেলাম। সেখানে কিছু পরীক্ষা করার পর রিপোর্ট হাতে নিয়ে চিকিৎসক বলেন, ওকে এখনই ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে যত দ্রুতসম্ভব, পারলে আজ রাতেই। অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করো।
তিনি বলতে থাকেন, রিপোর্ট হাতে নিয়ে দেখি, সেখানে লেখা লিউকোমিয়া। আমি কেবল দেখলাম, কিন্তু কিছু বুঝলাম না। আমার বোঝার মতো অবস্থাও তখন ছিল না। আসলে ওই মুহূর্তের কথা আমার এখন কিছু মনে নেই। আমি কী করেছিলাম, কী বলেছিলাম, কিছুই মনে নেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার মেয়ের কঠিন কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু হাতে টাকা নেই। কিভাবে ঢাকায় যাব, তাও জানি না। কিন্তু আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি, আজই মেয়েকে ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে।
২০১২ সালের ২৮ জুন, শুক্রবার। বিয়েতে পাওয়া গয়না আর সামান্য কিছু টাকা হাতে নিয়ে মেয়েকে নিয়ে রওনা হন দিপীর বাবা-মা। সেদিন ভোর ৪টার দিকে ঢাকায় পৌঁছান তারা। দিপীর একজন চাচা তখন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের উপাধক্ষ্য। তকে সঙ্গে নিয়ে দিপীর মা-বাবা গেলেন বেসরকারি একটি হাসপাতালে। পরীক্ষার জন্য রক্ত নেওয়া হলো মেয়ের। সে রিপোর্টেও এলো লিউকোমিয়া। বেসরকারি সেই হাসপাতালের একজন বড় চিকিৎসক পরামর্শ দিলেন, মেয়েকে ভারতে নিয়ে যেতে হবে। খরচ লাগবে ৩০ লাখ টাকা।
তাওহীদা বলেন, ‘৩০ লাখ টাকা… শুনেই আমি জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফিরলো, মনে হলো, এত টাকা আমি কোথায় পাব? আমার তো সম্বল কেবল অল্প কিছু সোনার গয়না! তা বিক্রি করেও তো ৩০ লাখ টাকা হবে না। তাহলে কি আমার ফুটফুটে মেয়েটা মরে যাবে? কেবল টাকা নেই বলে আমার মেয়েটা মরে যাবে…,’— বলেই হাতে মুখ ঢাকেন তিনি।
পরে অবশ্য ভারতে নিতে হয়নি দিপীকে। তাকে ভর্তি কার হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেই চিকিৎসা হয় তার। দিপীর মা বলেন, কখনও এখান থেকেই ওষুধ দিয়েছে, কখনও কখনও নিজেদেরও কিনে আনতে হয়েছে। তাতেও কম টাকা লাগেনি, নিজের সেই গয়না বিক্রি করেছি, জমি বিক্রি করেছি।
ডুঁকরে কেঁদে ওঠেন, হাতের তালু দিয়ে চোখ মোছেন। তাওহীদা বলেন, ওর বায়োপসি হলো। সেদিন থেকেই চিকিৎসা শুরু। কাঁথা সেলাই করি যে মোটা সূঁচ, সেই সূঁচ মেয়ের শরীরে ঢুকিয়ে রস বের করেন ডাক্তাররা। আমি তো মা হয়ে দেখতে পারি না। খসরু স্যার (অধ্যাপক ডা. এ কে এম আমিরুল মোরশেদ খসরু) বলেন, দিপীর মাকে সরায়ে নিয়ে যান। সে এক ভয়াবহ অবস্থা।
তাওহীদা কাঁদেন আর বলেন, এভাবেই সাড়ে তিন বছর চিকিৎসা হলো। টানা ৩৫ দিন ছিলাম এখানে। ছুটি দিতো, আবার আসতাম, আবার ছুটি নিতাম। আমি আর ওর বাবা দু’জনই সরকারি চাকরি করি। চাকরি ছেড়ে তো বেশিদিন থাকাও যায় না। বোনের বাসায় মায়ের কাছে দিপীকে রেখে যাই। হয়তো তিন দিন ক্লাস নেই, আবার ফিরে আসি। আমার দিপী তো ঢাকায়, আমি কী করে ওকে ছেড়ে থাকি! বলেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন তাওহীদা।
তিনি বলেন, সেই বাবা-মায়েরাই কেবল বুঝবে, যারা এখানে সন্তানের এই চিকিৎসা করায়। আমি আপনাকে যতই বলি, আমার সেই দিনগুলো আপনি বুঝবেন না। কী যে একেকটা দিন গেছে। রাতে ঘুমাতে পারতাম না। কেবল দেখতাম প্লাটিলেট কমে গেল কি না, নতুন করে শরীরে আবার সেই জখমের মতো হলো কি না।
তিনি বলেন, যখনই ইনজেকশন দিত, তখনই বমি শুরু করত, মেয়েটা নিশ্চুপ হয়ে যেত। আমি ওকে সে অবস্থাতেই কাঁধে নিয়ে ঘুরতাম। কোন মুহূর্তে কী হবে, আমি কিছুই বুঝতেছি না। এভাবেই দিন যেত। প্রথম ইনজেকশন দেওয়ার ১৪ দিন পর আবার চিকিৎসা শুরু হলো।
নীরব শ্রোতা পেয়ে তাওহীদা বলতে থাকেন, চোখের সামনে কত বাচ্চা মারা গিয়েছে। একইসঙ্গে ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরই জ্বর এসেছে, চোখের সামনে মারা গিয়েছে। কত যে আতঙ্কের ভেতরে দিন পার করেছি। অনেক যুদ্ধ করে করে ২০১৫ সালে চিকিৎসা বন্ধ হয়েছে। এখন মাঝে মাঝে আসি, কিছু পরীক্ষা হয়। আল্লাহর রহমতে দিপী এখন ভালো আছে।
আরও পড়ুন: ক্যান্সার সারভাইভার’স মান্থ- নতুন করে ফিরে পাওয়া জীবন
দিপীর চিকিৎসার মধ্যেই ছিল ২০১৪ সালের নির্বাচন। তাওহীদা বলেন, নির্বাচনের আগে গাড়ি পোড়াচ্ছে, ট্রেনে আগুন দিচ্ছে। অথচ ওকে নিয়ে আসা দরকার। এর মধ্যেই মেয়েকে বুকের ভেতরে জড়িয়ে ধরে নিয়ে এসছি। অথচ হাসপাতালে আসার পর শুনতাম, শরীরের কোনো একটা অসুবিধার জন্য হয়তো সেদিন ওর কেমো হবে না। বোনের বাসায় মায়ের কাছে ওকে রেখে চলে যেতাম। আমাকে তো স্কুল করতে হবে। ওকে নিয়ম করে ওষুধ দিয়ে কুলি করাতে হতো। গরম পানিতে ওষুধ দিয়ে বড় বোলে বসিয়ে রাখতে হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিন্তু অতটুকুন অসুস্থ মেয়েকে কি ওভাবে বসিয়ে রাখা যায়? নিজের মনে প্রশ্ন করেই তাওহীদা বলেন, আমি ওরে গামলার (বোল) ভেতরে বসিয়ে গলা ধরে বসে থাকতাম। গল্পের বই পড়ে শোনাতাম, গান গেয়ে শোনাতাম। এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখতাম।
দিপীর মা বলেন, ওর বাবা এখনও বলে, তুমি এত কষ্ট করছ! ডাক্তাররাও বলেন, দিপীর মা এত কষ্ট করছে। সবাই বলে আমি কষ্ট করেছি ওর জন্য। আল্লাহর কাছে শুধু বলেছি, কেবল তুমিই পারো, কারও কোনো শক্তি নাই। তুমি আমার মেয়েকে কেড়ে নিও না, আমার কোল শূন্য করে দিও না।
দিপী কি তার কঠিন অসুখের কথা বুঝতে পারে— প্রশ্ন করলে তাওহীদা বলেন, আজকের আগ পর্যন্ত কিছু বুঝত না। কিন্তু আজ যখন এখানে এলাম তখন সে প্রথম প্রশ্ন করল, আমি এখানে এসছি কেন মা? আমার কি ক্যান্সার হয়েছে? ওকে জড়িয়ে ধরে বলি, না মা, তোমার কিছু হয়নি।
‘আল্লাহর রহমতে দিপী এখন ভালো আছে,’— বলে হাতের তালু দিয়ে আবার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি মোছেন তাওহীদা।
সারাবাংলা/জেএ/টিআর