গ্রামীণ নারীর কাজ দৃশ্যমান, কাজের মূল্য অদৃশ্য!
১৬ অক্টোবর ২০১৮ ০৮:৫৬
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কত-শত কাজ গ্রামীণ নারীর। প্রাত্যহিক রান্না, গৃহপালিত পশুর দেখাশোনা, সন্তানের পরিচর্যা, বাড়ি-ঘর পরিষ্কার, কাপড়-চোপড় ধোয়া। এর পাশাপাশি গ্রামীণ নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ রয়েছে কৃষিকাজে। গ্রামে কৃষিকাজে নারীদের অংশগ্রহণ কোনোভাবেই পুরুষের চেয়ে কম না। বরং, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষকে ছাপিয়ে নারীর অংশগ্রহণই বেশি। এসব নারীর কাজ দৃশ্যমান হলেও তার কাজের মূল্য থেকে যাচ্ছে অদৃশ্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীরা পারিবারিক শ্রম ছাড়াও কৃষি, মৎস্য, বনায়ন, গবাদিপশু পালনসহ বিভিন্ন ধরনের শ্রমে অবৈতনিকভাবে জড়িত। অথচ এসব অদৃশ্য শ্রমের আর্থিক মূল্য না থাকায় তাকে পরিবার ও সমাজে অবমূল্যায়িত হতে হয়। নারীর শ্রমকে পারিবারিক কাজ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এ কাজ অবৈতনিক এবং তার জন্য কোনো আর্থিক মূল্য পান না নারীরা। যদি নারীর অবমূল্যায়িত কাজের অংশ জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ করা হতো, তাহলে জাতীয় উৎপাদনে নারীর অবদান ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪০ শতাংশ হতো।
শ্রমশক্তি জরিপের হিসাব অনুযায়ী, দেশের মোট ১ কোটি ২০ লাখ নারী শ্রমিকের মধ্যে শতকরা ৭৭ শতাংশই গ্রামীণ নারী। যারা মূলত কৃষিকাজ, হাঁস-মুরগি পালন, পশুপালন এবং মাছ চাষের মতো কৃষিসংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৃষিখাতে নারীর এই অংশগ্রহণকে পারিবারিক শ্রম হিসেবে গণ্য করা হয়, যা সম্পূর্ণ অবৈতনিক এবং আর্থিক মূল্যহীন। গবেষণা থেকে জানা যায়, কেবলমাত্র বীজ বপন থেকে শুরু করে ধান উৎপাদনের ২৫টি ধাপের মধ্যে অন্তত ২০টিতেই নারীর অবদান রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশের কৃষিতে নারীর অবদান ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ।
যদিও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কাছে কৃষি কাজে জড়িত নারীদের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই! নারীরা কৃষক বলেও চিহ্নিত নন। খোদ এই অধিদফতরের কাছ থেকেও নারীর অবদান নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তবে একাধিক তথ্য মতে, গত এক দশকে অবৈতনিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ শ্রমিকের ৫০ লাখই নারী।
দেশে প্রথমবারের মতো ১৯৯৫-৯৬ সালে শ্রম জরিপে নারীকে কৃষক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কৃষিতে নারী শ্রমিকের সংশ্লিষ্টতার এটিই ছিল প্রথম স্বীকৃতি। আর ২০০৫-০৬ সালের শ্রম জরিপে বলা হয়, ১৫ বছরের ওপরের জনশক্তির ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত। ওই জনশক্তির ৪২ শতাংশ পুরুষ এবং ৬৮ শতাংশ নারী। এসব নারীরা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পূর্বের ওই জরিপ অনুযায়ী, কৃষিতে নারীর অবদান পুরুষের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি।
২০০৮ সালে করা বিশ্বব্যাংকের আরেক জরিপের তথ্য থেকে জানা গেছে, দেশের কৃষিতে নারীর অবদান শতকরা ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ। তবে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারী শ্রমিকের অবদান অন্তভুর্ক্ত করা হয়নি, নেই কোনো পৃথক পরিসংখ্যানও।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর মজুরি ও স্বীকৃতিহীন কাজের অর্থনৈতিক মূল্য নিরূপণের উদ্দেশ্যে এবং জিডিপির মানদণ্ডে তার তুলনা করার জন্য সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন জরিপ করে। ‘জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদান নিরূপণ’ শীর্ষক সেই গবেষণায় দেখা যায়, একজন নারী মজুরি ছাড়া প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮ ঘণ্টা কাজ করেন, অন্যদিকে পুরুষ করে আড়াই ঘণ্টা। একজন নারীর মজুরিহীন কাজের সংখ্যা প্রতিদিন গড়ে ১২ দশমিক ১টি, যা জিডিপিতে যোগ হয় না। পুরুষের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ২ দশমিক ৭টি।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘কৃষি ক্ষেত্রে কেবল ধান উৎপাদনে ২৫টি ধাপের মধ্যে অন্তত ২০টি কাজ নারীরা এককভাবে করছে। বাকিগুলোর পুরুষদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে করলেও নারীরা যতটুকু বিনিয়োগ করে কৃষিকে উন্নত করছেন, সমৃদ্ধ করছেন, তারা সেই স্বীকৃতি পাচ্ছেন না।’
নারীরা মৎস্য, গবাদিপশু লালন-পালনের মতো বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে রয়েছেন। কিন্তু এসব শ্রমের কোনো আর্থিক মূল্য না থাকায় পরিবারে নারীর মতপ্রকাশ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার পাচ্ছে না বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস উদযাপন জাতীয় কমিটির সচিবালয় সমন্বয়কারী ফেরদৌস আরা রুমী।
তিনি বলেন, এ জন্য প্রয়োজন নারীর অদৃশ্য শ্রমের আইনি স্বীকৃতি এবং মূল্যায়ন, যা তাকে পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে তার অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে নেবে।
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শার্মিন্দ নীর্লমি সারাবাংলাকে বলেন, কৃষিতে নারীর কাজকে ঘরের কাজ বলেই ধরে নেওয়া হয়েছে। অনেকটা ‘এক্সটেনশন অব ঘরের কাজ’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, কৃষিতে পুরুষের কাজের হার কমেছে এবং নারীর কাজ বেড়েছে। কিন্তু তাতে করে কৃষির উৎপাদনে ঘাটতি আমরা দেখিনি। তাহলে নারী কেন তার কাজের মূল্য পাবে না?— প্রশ্ন রাখেন তিনি।
দেশের শ্রমশক্তির অংশ হতে পারেন— ১৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী এমন নারীর ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে ৮২ শতাংশ ‘আনপেইড ফ্যামিলি লেবার’, যাকে অর্থনীতির পরিভাষায় বলা হয় ‘ওউন অ্যাকাউন্ট ওয়ার্কার’। অর্থাৎ, তারা কাজের কোনো পেমেন্ট বা মজুরি পান না।
বেসরকারি টিভি চ্যানেল নিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রধান বার্তা সম্পাদক শাহনাজ মুন্নী বলেন, কৃষিতে নারীর অবদানের কোনো মূল্যায়ন বা স্বীকৃতি নেই। এখনও কৃষক বলতে পুরুষের অবয়বই চোখে ভাসে। আবার কাজের সময় নারীকে জমিতে দেখা গেলেও মালিকানার দাবি পুরুষের। সেই সঙ্গে ঘরে পালা হাঁস-মুরগির ডিম, গরু-ছাগলের দুধ, শাক-সবজি বিক্রি করেন পুরুষ এবং তার অর্থমূল্যও গ্রহণ করেন তিনি। এমনকি, সেই পণ্য বিক্রি করে সেই টাকা খরচ করার সিদ্ধান্তও নিয়ে থাকেন পুরুষ।
এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম জনমত তৈরি করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে জানিয়ে শাহনাজ মুন্নী বলেন, সংবাদে প্রান্তিক গ্রামীণ নারীর চিত্র খুব কমই তুলে ধরা হয়। প্রিন্ট বা ব্রডকাস্ট— দুই ধরনের গণমাধ্যমেই গ্রামের খবরের জন্য নির্ধারিত পাতা বা নির্ধারিত অনএয়ার সময়ে গ্রামীণ নারীর সংগ্রামকে খুব বেশি দেখানো হয় না। অথচ মানুষের কাছে গ্রামীণ নারীর প্রকৃত অবস্থা সর্ম্পকে জানাতে সচেতনতা তৈরির বিকল্প নেই।
সারাবাংলা/এটি