বিজ্ঞাপন

কৃষির ৮০ শতাংশই নারীর হাতে, তবু নেই স্বীকৃতি

October 15, 2018 | 9:13 am

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত একটি গণমাধ্যমে অফিসে জেন্ডার বিষয়ক এক কর্মশালায় বলা হয়, মাঠে কাজ করছে— এমন একটি চরিত্র হাতে এঁকে দেখাতে। ২০ জনের সেই কর্মশালায় দু’জন ছাড়া বাকি সবাই এঁকেছিলেন পুরুষ চরিত্র। অথচ কৃষিকাজে দেশের গ্রামীণ নারীদের অবদান পুরুষের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। কৃষিকাজ কেবল পুরুষরাই করে— এমন ধারণা প্রচলিত থাকলেও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন বলছে, কৃষি খাতের সিংহভাগ কাজই করে থাকেন নারীরা।

ক্যাম্পেইন ফর সাসটেইনেবল রুরাল লাইভলিহুডের (সিএসআরএল) ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২১ ধরনের কৃষি খাতে ১৭ ধরনের কাজেই গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে। সেই হিসাবে, কৃষি খাতের ৮০ শতাংশ কাজই করছেন নারী। ফসলের প্রাক-বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে বীজ সংরক্ষণ, ফসল তোলা, প্রক্রিয়া ও বিপণনের কাজও রয়েছে এর মধ্যে। কিন্তু এত কাজের পরও নারীদের এসব কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই।

আরও পড়ুন: এখনো মেলেনি কিষাণীর শ্রমের স্বীকৃতি

বিজ্ঞাপন

আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস, কৃষিতে নারী, কৃষি অর্থনীতি

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামে কৃষিকাজে নারীদের অংশগ্রহণ কোনোভাবেই পুরুষের চেয়ে কম না। বরং, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষকে ছাপিয়ে নারীর অংশগ্রহণই মুখ্য। কিন্তু আজ পর্যন্ত কৃষিকাজে নারীর অংশগ্রহণকে বিবেচনা করা হয়নি, মূল্যায়ন করা হয়নি তাদের এই শ্রম। মেলেনি নারীর স্বীকৃতি ও মর্যাদা।

আজ ১৫ অক্টোবর, আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস। ১৯৭৪ সালে প্রথম জাতিসংঘ জনসংখ্যা সম্মেলন এবং জাতিসংঘ খাদ্য সম্মেলনে বিশ্বে, বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের সংকটজনক অবস্থানকে তুলে ধরা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৯৫ সালে চীনের বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে ১৫ অক্টোবরকে বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৯৭ সাল থেকে জেনেভাভিত্তিক ওয়ার্ল্ড উইমেন সামিট ফাউন্ডেশন দিবসটি পালনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি পালন করে। পরে ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সভায় ১৫ অক্টোবর বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস পালনের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন: ‘কর্মসংস্থানে পিছিয়ে সিলেট ও বরিশালের নারীরা’

আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস, কৃষিতে নারী, কৃষি অর্থনীতি

দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বিশ্বব্যাপী কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তায় গ্রাম ও পল্লি উন্নয়নে গ্রামীণ নারীদের অবদানের স্বীকৃতি ও অবদানের গুরুত্বকে তুলে ধরা। একইসঙ্গে গ্রামীণ নারীদের বহুমাত্রিক ভূমিকা ও অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া ও সম্মান করা, যা গ্রাম উন্নয়নের পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ও গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ নারী। তাদের ৮৬ শতাংশই বাস করেন গ্রামে। আর গ্রামীণ এসব নারী দিনের মোট সময়ের ৫৩ শতাংশ সময় ব্যয় করেন কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্পে, যেখানে এসব কাজে পুরুষদের সময় ব্যয় হয় ৪৭ শতাংশ। দেশের খাদ্য সংকট মোকাবিলায় মোট নারী শ্রমশক্তির শতকরা ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ নারী কৃষিকাজে নিয়োজিত থাকলেও আর্থসামাজিক অবস্থান পুরুষের তুলনায় নারী দারিদ্র্যসীমার প্রায় ৪৩ শতাংশ নিচে বাস করে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শ্রমশক্তির জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট এক কোটি ২০ লাখ নারী শ্রমিকের মধ্যে শতকরা ৭৪ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ৯২ লাখ নারীই কৃষিকাজ, মৎস্য চাষ ও সামাজিক বনায়নের সঙ্গে যুক্ত।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন: ‘নারীর পারিবারিক শ্রমের আর্থিক স্বীকৃতি দিতে হবে’

আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস, কৃষিতে নারী, কৃষি অর্থনীতি

সিএসআরএলের ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কৃষি খাতের ২১ ধরনের কাজের মধ্যে ১৭ ধরনের কাজেই গ্রামীণ নারীরা অংশ নিয়ে থাকেন। ফসলের প্রাক-বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে বীজ সংরক্ষণ, ফসল তোলা, প্রক্রিয়া ও বিপণনের কাজও রয়েছে সেখানে। কিন্তু এত কাজের পরও এসব কাজের স্বীকৃতি মেলে না নারীদের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ কৃষি মজুরিভিত্তিক জরিপ থেকেও জানা যায়, একজন পুরুষ যদি কৃষি মজুরি হিসেবে পান ১০০ টাকা, সেখানে নারী পেয়ে থাকেন ৭৫ টাকা। পরবর্তী সময়ে এই বৈষম্য কমলেও তার গতি খুবই ধীর।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. ইসমত আরা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, কৃষিকাজ বলতে কেবল ক্ষেত-খামারের কাজ নয়, শস্য উৎপাদন, হাস-মুরগি-গরু-ছাগল পালন এবং মৎস্য উপদানকেও বোঝায়। সে হিসেবে কৃষিখাতের ২১টি কাজের মধ্যে ১৭টি কাজই নারীরা করে থাকেন। কিন্তু তাদের কোনো স্বীকৃতি নেই। একইসঙ্গে সরকারের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় যে ১০০ দিনের কাজের কর্মসূচি, সেখানেও গ্রামীন নারীরা কাজ করছেন। গ্রামের যে রাস্তা-ঘাট তৈরির কাজ, সেখানেও রয়েছে তাদের অংশগ্রহণ। কিন্তু সেখানেও রয়েছে মজুরি বৈষম্য। কাগজে-কলমে সমান মজুরির কথা থাকলেও নারীদের দেওয়া হচ্ছে কম।

আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস, কৃষিতে নারী, কৃষি অর্থনীতি

আবার কৃষিতে জমি প্রস্তুত থেকে শুরু করে ধান লাগানো, রোপন করা থেকে ধান মাড়াই, বাছাই-প্যাকেটজাত করা— সব জায়গায় পুরুষের চেয়ে নারীর অংশগ্রহণই বেশি। একইসঙ্গে গবাদি পশু, মাছ পালনের মতো ক্ষেত্রগুলোতেও নারীর অংশগ্রহণ বেশি। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ‘মার্কেটিং’য়ে নারীর অবদান কম উল্লেখ করে এর কারণ হিসেবে অধ্যাপক ইসমাত আরা বলেন, এখানেই পুরুষশাসিত সমাজ ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দেখিয়ে নারীদের দমিয়ে রাখে। তারা নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দেয়নি বলেই আমি মনে করি।

অধ্যাপক ইসমত আরা আরও বলেন, আবার গ্রামের সব জমির মালিকও পুরুষ না। নারীরা পারিবারিক সূত্রে এবং স্বামীর কাছ থেকেও জমি পেয়ে থাকেন। কিন্তু কতজন নারী নিজের ইচ্ছেমতো সে জমি বিক্রি করতে কিংবা সে জমিতে ফসল চাষ বা অন্য কাজে জমি নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত নেন?— প্রশ্ন রাখেন তিনি।

আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস, কৃষিতে নারী, কৃষি অর্থনীতি

নারীর অধিকার আদায়ে কেবল নারীদের কাজ করলেই হবে না, পুরুষদেরও তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক ইসমত আরা। তিনি বলেন, নারীর এ অধিকার আদায় করা যেতে পারে আইন করে কিংবা কাউন্সেলিং করে। একইসঙ্গে গণমাধ্যমকে এ নিয়ে কাজ করতে হবে। আর আইন করে বসে থাকলেই হবে না, তার সঠিক বাস্তবায়নও করতে হবে। তবেই আসবে নারীর কাজের স্বীকৃতি।

আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস উদযাপন জাতীয় কমিটির সভাপ্রধান শামীমা আক্তার বলেন, বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ৩৪৫ ধারা অনুযায়ী, নারী-পুরুষের সমান কাজে সমান মজুরির কথা থাকলেও চারা রোপণ ও ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে পুরুষদের দৈনিক মজুরি যেখানে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা, নারীরা সেখানে পায় মাত্র ৩৫০ টাকার মতো। কাজেই, আপাতদৃষ্টিতে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর পেছনে নারীর ক্ষমতায়নের কথা মনে হলেও এর মূল নেপথ্যে রয়েছে স্বল্প মজুরি দিয়ে দীর্ঘক্ষণ কাজ করানোর সুবিধা— বলেন শামীমা আক্তার।

সারাবাংলা/জেএ/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন