দোকান-অনলাইনেও মিলছে চোরাই পণ্য!
৫ জানুয়ারি ২০১৮ ১০:১১ | আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৮ ১৮:৩৯
মো. শামীম রিজভী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: রাজধানীতে চুরি-ছিনতাই হওয়া পণ্যগুলো অনলাইন মার্কেটপ্লেস, ফুটপাতের দোকান, এমনকি নামী-দামী শপিং কমপ্লেক্সেও পাওয়া যাচ্ছে। এসব পণ্য সেখানে বিক্রি করে দিচ্ছে চোর ও ছিনতাইকারীরা।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে ল্যাপটপ, ট্যাব ও মোবাইল ফোন চুরি-ছিনতাইয়ের পর তা যায় ওই সব দোকানে। এর ফাঁকে অনলাইনে দেয়া হয় চোরাই পণ্যের বিজ্ঞাপন। গুলিস্তান স্টেডিয়ামের বাইরে, পাতাল মার্কেট, বঙ্গবাজার, মিরপুর শাহআলী মাজার, গাবতলী, উত্তরা, ওয়াইজঘাট ও চকবাজারের বেগমবাজারের ফুটপাতেই মেলে ভালমানের চোরাই পণ্য। নামী-দামী শপিং কমপ্লেক্সগুলোও পিছিয়ে নেই। বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্স, এলিফ্যান্ট রোড, গুলশান এভিনিউ, মলি ক্যাপিটা সেন্টার, ধানমন্ডির অরচার্ড পয়েন্টসহ বেশকিছু নামী শপিং কমপ্লেক্সের দোকানগুলোতেও পাওয়া যায় চোরাই পণ্য। এ সব স্থানে সস্তায় আরো মেলে কম্পিউটারের বিভিন্ন সামগ্রি, প্রিন্টার, ক্যামেরা, বিদেশি ঘড়ি, টিভি, টেলিফোন সেট, সব ধরনের ব্যাটারি ইত্যাদি। দাম কম হলেও এসব পণ্যের গুণগতমান কিন্তু খারাপ নয়। আবার সব পণ্যই চোরাই নয়।
গুলিস্তানের ফুটপাতে এমন চোরাই পণ্য নিয়ে বসা পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানি সারাবাংলাকে বলেন, অনেকেই ব্যবহার করা ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিক্রি করতে আসেন। আমরা দেখে যদি ভাল মনে করি তাহলে কিনে রাখি। অনেক ধরনের মানুষ আসে পণ্য বিক্রি করতে। কে কেমন কিভাবে বলি। তবে যারা মোবাইল-ল্যাপটপ বিক্রি করতে আসে তারা বেশিভাগই নেশাগ্রস্থ; এটা দেখলেই বোঝা যায়।
তিনি আরও বলেন, আমরা দেখলেই বুঝতে পারি কোনটি চোরাই পণ্য, আর কোনটি ব্যবহার করার পর বিক্রি করতে এসেছে। তাই আমরা চোরাই পণ্য পেলেই কেনার পর পরই বিক্রি করি না। দেখা গেল কোন ভাল চোরাই মোবাইল বা ল্যাপটপ বিক্রি করতে কেউ এসেছে। আমরা সেটা প্রথমে কিনে রেখে দেই। পরে যদি একই মডেলের অন্য কোন নষ্ট মোবাইল বা ল্যাপটপ পাই, তাহলে নতুনটির সঙ্গে পুরানটির যন্ত্রাংশ পরিবর্তন করে দুটোই সচল করার চেষ্টা করি। কিন্তু বিক্রির পর কখনও স্বীকার করি না যে এই পণ্যটি আমরা বিক্রি করেছি এবং ক্রেতাদেরও মানা করে দেওয়া হয় বিক্রেতা সম্পর্কে কাউকে বলতে।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক নামী শপিং মলে এক মোবাইল-ট্যাব বিক্রেতা সারাবাংলাকে জানান, অধিক লাভের জন্য তারা বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে চোর-ছিনতাইকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। তারা এজেন্টদের মাধ্যমে বিভিন্ন চোর-ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে কম দামে মোবাইল-ট্যাব কিনে থাকেন। এগুলো পরে তারা ওই সব মোবাইল-ট্যাবের কোম্পানির হুবহু প্যাকেটে বিক্রি করে। এমনকি আইএমইআই নম্বরের জন্য নকল স্টিকার বানিয়ে তা প্যাকেটের গায়ে লাগিয়ে নতুন মোবাইল হিসেবে সাধারণ ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দেয়। আসল সেট শো-রুমের থেকে কম দামে পাওয়ায়, সাধারণ ক্রেতারাও এতে প্রলুব্ধ হয়।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে ৯০টি চোরাই ল্যাপটপসহ খলিল গাজী, আব্দুল কালাম, এমদাদুল হক, হাসিবুর রহমান শুভ্র, মনির ব্যাপারী ও মুশফিকুর রহমান নামে ৬ জনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) দক্ষিণ বিভাগ। এরা ল্যাপটপ বাজারে বিক্রির পাশাপাশি অনলাইনেও বিক্রি করতো। গ্রেফতারদের দেওয়া তথ্যে, হাসিবুরের বাসা থেকে ৫৬টি ল্যাপটপ ও বসুন্ধরা সিটি শপিংমলের এবি ইলেকট্রনিক্সের মুশফিকুরের কাছ থেকে ৩৪টি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়।
২৬ ডিসেম্বর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫৬ জন ছিনতাইকারী গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগ। রাজধানীর ছিনতাইপ্রবণ এলাকা যেমন যাত্রাবাড়ী, কারওয়ান বাজার, সোনারগাঁও মোড়, বাংলামটর থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত একটি চাইনিজ কুড়াল, ৩টি চাপাতি ও ২টি চাকু উদ্ধার করা হয়। এদের অধিকাংশই মাদকাসক্ত। অনেক সময় মাদক কেনার জন্য ছিনতাই করা ১০ হাজার টাকা দামের মোবাইল ফোন মাত্র দুই হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয় তারা।
চোরাই মোটরপার্টসের জন্য পুরান ঢাকার ধোলাইখাল বিখ্যাত। এখানে শুধু রাজধানীর চোরাই মোটরপার্টসই আসেনা, সারাদেশের চোরাই মোটরপার্টস এনে বিক্রি করা হয়। আস্ত একটা গাড়ি ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই খুলে পার্টসগুলো সারি সারি সাজিয়ে রাখা হয় দোকানে। পরে সেগুলো অনেক কম দামে বিক্রি হয়। এমনভাবে পার্টসগুলো বিক্রি করা হয় যে, যার গাড়ি থেকে পার্টসগুলো চুরি হয়েছে সে নিজে কিনলেও চিনতে পারবে না। লালমোহন স্ট্রিট ও মসজিদ মার্কেটের পরে বেশ কয়েকটি দোকানেও চোরাই যন্ত্রাংশ বিক্রি হয়।
ডিবির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মো. আবদুল বাতেন বলেন, চোর-ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে ডিবির তৎপরতা সব সময়ই থাকে। ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে এই অভিযানে নগরবাসীর মনে স্বস্তি ফিরে আসবে। তাই ডিবির এমন অভিযান অব্যাহত থাকবে। এছাড়াও ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে তৎপরতা বাড়াতে ডিএমপির সব বিভাগের সমন্বয়ে ২১ ডিসেম্বর একটি বৈঠক হয়।
মিরপুরের শাহ আলি মাজার শরীফের কাছে ফুটপাথে প্রতি সন্ধ্যায় জমে ওঠে চোরাই জুতার মার্কেট। এখানে অনেক দামী চামড়ার জুতা অল্প দামেই পাওয়া যায়। দেশীয় শীর্ষ সারির ব্র্যান্ড এপেক্স, বাটার স্যান্ডেল ও বিদেশী জুতা কম দামে পাওয়া যায়। অবশ্য সবই নতুন মডেলের নয়। চুরি করা পুরান জুতা পলিশ করে চকচকা করা হয়।
পুরান ঢাকার বেগমবাজার ও ওয়াইজঘাট এলাকায় অস্থায়ী দোকান দিয়ে চোরাই কসমেটিক্স, মেয়েদের বিভিন্ন পোষাক, জুতা পাওয়া যায়। নাজিমউদ্দিন রোডের পাশে বেচারাম দেউরি রোডে অস্থায়ী দোকানগুলোতে চলে দামি জুতা, প্যান্ট, শাড়ি, পাঞ্জাবি, থ্রি-পিস, লুঙ্গি, ল্যাপটপ, ক্যামেরা, ঘড়ি, মোবাইলসহ বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিক্রি। বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারী ক্রেতারা এগুলো কিনতে ভোর থেকেই ভিড় জমান।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান উন্নয়ন কর্মকর্তা আবু তালেব মো. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, ফুটপাতে ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের জন্য তালিকা করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে অস্থায়ী দোকানের ব্যবসায়ীদের নিয়ে কাজ করা হবে। এটি চলমান প্রক্রিয়া।
১৩ নভেম্বর বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্স, গুলশান এভিনিউ মলি ক্যাপিটা সেন্টার, ধানমন্ডির অরচার্ড পয়েন্টসহ কয়েকটি মার্কেটে অভিযান চালিয়ে আইফোন, অত্যাধুনিক ড্রোন, মোবাইলসহ বিপুল পরিমাণ চোরাই ফোন আটক করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। ওই দিন শপিং কমপ্লেক্সে শুল্ক গোয়েন্দার আসার খবর পেয়ে বসুন্ধরার ৬তলা এবং নিচতলার মোবাইলে ফোনের অধিকাংশ দোকানই বন্ধ করে ফেলেন দোকানিরা। বসুন্ধরা শপিং মলের ৯টি দোকান, গুলশান অ্যাভিনিউর একটি ও ধানমন্ডির অরচার্ড পয়েন্টের একটি দোকানে এই অভিযান চালানো হয়। দোকানগুলো থেকে আনুমানিক এক কোটি টাকা দামের ১৫টি আইফোন-১০, অন্যান্য মডেলের আইফোন ১১৮টি, অ্যাপল আইপ্যাড ৮টি, স্যামসাং ৫৮টি, নোকিয়া ২টি, ভারতু ব্র্যান্ডের একটি এবং ব্ল্যাকবেরি ২টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। গুলশান ও বসুন্ধরা মার্কেটের ফোনএক্সচেঞ্জ দোকানের দুটি শোরুম থেকে মোট ৮৮টি দামি চোরাই সেট উদ্ধার করা হয়। ফোনএক্সচেঞ্জ দোকানের গুলশান শো-রুম থেকে আমদানি নিষিদ্ধ একটি অত্যাধুনিক ড্রোনও উদ্ধার করা হয়।
এর আগেও বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে অভিযান চালিয়ে ৭১টি চোরাই মোবাইল সেট উদ্ধার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-২)। মলের ১ লেভেলের বি- ব্লকের ১১ নম্বর দোকানে নিউ এশিয়ান টেলিকম থেকে ৭১টি চোরাই মোবাইল সেটসহ দোকানের মালিক এম আর বশির (৪৪) ও কর্মচারী জামাল হোসেনকে (৩০) আটক করা হয়। জব্দ মোবাইল সেটগুলো কেনার কোনো আইনসম্মত নথিপত্র দেখাতে পারেন নি ওই দোকান মালিক।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম বলেন, অবৈধ সেটের আইএমইআই নম্বর ঠিক থাকে না। ফলে চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধে এ সব মোবাইল সেট ব্যবহার হয়। তাই জনগণকে সচেতন করার জন্য অভিযান চালানো হয়।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান জানান, চোরাই পণ্যের বিরুদ্ধে অভিযান নিয়মিতভাবে পরিচালনা করা হবে এবং আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সারাবাংলা/এসআর/এসআই