আড়াই বছরের আয়ান ও একজন আইয়ুব বাচ্চু
২১ অক্টোবর ২০১৮ ১৯:২৮
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: রুপালি গিটার ফেলে ঘুমন্ত শহরে পাড়ি দিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু। তারা ভরা রাতে আর কোনো দিন তিনি গাইবেন না, তার গিটারের মূর্ছনায় উন্মাতাল হবে না আর তরুণ প্রজন্ম।
গত ১৯ অক্টোবরে আইয়ুব বাচ্চু মারা গিয়েছেন। দুদিন পার হলেও গলির দোকান, অফিসের কম্পিউটার, মোবাইল ফোনে এক নাগাড়ে বাজছে আইয়ুব বাচ্চুর গান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখনও চলছে বাচ্চু বন্দনা। তবে গানকে ছাড়িয়ে আইয়ুব বাচ্চুর আরেক পরিচয় জানান দিলেন সৌরভ আল জাহিদ।
ব্যবসায়ী সৌরভ আল জাহিদ ফেসবুকে আইয়ুব বাচ্চু এবং তার আড়াই বছর ভাগিনাকে নিয়ে ঘটে যাওয়া এক ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন।
একজন মহামানব এবং একটি না বলা ঘটনা শিরোনাম দিয়ে সৌরভ লিখেছেন, ‘২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আমার আড়াই বছর বয়সী ভাগিনা আয়ানকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে জরুরি ভিত্তিতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপারেশন করানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। অপারেশনটা ছিলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল। আয়ানকে বাঁচাতে হলে এই অপারেশনের কোনো বিকল্প ছিলো না।
বিভিন্ন সোর্স থেকে অপারেশনের জন্য টাকা সংগ্রহ করার পরও প্রায় দেড় লক্ষ টাকার ঘাটতি ছিলো, যা কোনভাবেই এই অল্প সময়ের মধ্যে জোগাড় করতে পারছিলাম না। তখন আর উপায়ান্তর না দেখে ফেসবুকে আায়ানের অপারেশনের জন্য সাহায্য চেয়ে একটা পোস্ট দেই রাত আনুমানিক তিন টার দিকে। হাতে আর সময় ছিলো সাত ঘণ্টার মতো।
কিন্তু সকাল ন’টা পর্যন্ত কারও কোনো সাহায্য না পেয়ে হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম জানিয়ে তিনি আরও লেখেন, ডাক্তার সাহেবকে অনুরোধ করলাম অপারেশন শুরু করার প্রস্তুতি নিতে এবং সংগৃহিত টাকা পেমেন্ট করে বকেয়া টাকার জন্য তিন ঘণ্টা সময় নিলাম। আয়ানকে তখন জরুরি বিভাগ থেকে আনা হবে অপারেশন থিয়েটারে, তাই অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
ঠিক তখনই এক মহান ব্যক্তির আগমন ঘটলো সেখানে। এসেই তিনি আয়ানের অভিভাবককে খুঁজতে লাগলেন। আমরা তখন উনার সঙ্গে কথা বললাম এবং খুবই অবাক হলাম উনাকে দেখে। জানতে পারলাম উনি ফেসবুকের পোস্টটা দেখে আয়ানকে দেখতে এসেছেন।
উনি আয়ানকে দেখার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। জরুরি বিভাগ থেকে আয়ানকে অচেতন এবং অক্সিজেন মাস্ক পরানো অবস্থায় অপারেশন থিয়েটারের সামনে আনা হয়। ওই ভদ্রলোক আয়ানকে দেখে কাছে গেলেন এবং আয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দুই তিন বার বললেন, ‘আয়ান বাবুটা, সোনামনিটা, আল্লাহ্ তোমাকে ভালো করে দিবেন, সুস্থ করে দিবেন।’ এ কথাগুলো বলে তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিলেন। ওনার কান্না দেখে আমরাও কেঁদে ফেললাম।
এর কিছু সময়ের মধ্যেই আয়ানকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকানো হলো। প্রায় চার ঘণ্টা লাগলো অপারেশন শেষ হতে। আল্লাহর অশেষ রহমতে অপারেশন সফল হলো। ওই বিশেষ ব্যক্তিটি তখন জানালেন সম্পূর্ণ বকেয়া টাকা তিনি পরিশোধ করে দিয়েছেন, এবং অনুরোধ করলেন যে উনি জীবিত থাকা অবস্থায় আমরা যাতে ওনার এই আর্থিক সহযোগিতার কথা কাউকে না বলি।
আজ উনি জীবিত নেই….
তাই নিজেকে কোনভাবেই আর আটকাতে পারলাম না, বলে ফেললাম বলেন সৌরভ আল জাহিদ। তিনি বলেন, সেই মানুষটি আর কেউ নন, প্রিয় আইয়ূব বাচ্চু!
যোগাযোগ করা হলে সৌরভ আল জাহিদ সারাবাংলাকে বলেন, কেবল সে অস্ত্রেপচারের টাকা না, এরপরে স্কয়ারে হাসপাতালে দুদিন থাকার বিলও তিনি পরিশোধ করে দিয়েছিলেন, যেটা আমরা চলে আসার সময় বিল পরিশোধ করতে গিয়ে জানতে পারি। হাসপাতাল থেকে ফেরত আসার পর দুই-তিন দিন পরপরই তিনি খোঁজ নিতেন, ফোন দিতেন।
আমাদের ইচ্ছে ছিল, আয়ান আরেকটু বড় হলে তার সামনে আবার সুস্থ আয়ানকে নেব, তাকে বাসায় আমন্ত্রণ করবো। কারণ, আইয়ুব বাচ্চুতো আমাদের কাছে আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন না, তিনি আমাদের কাছে দেবতাতুল্য ছিলেন, তিনি আমাদের কাছে অনেক কিছু। তবে সারাজীবনের জন্য আফসোস থেকে যাবে-তাকে আর বাসায় আমন্ত্রণ জানানো হবে না, আয়ান আর তাকে দেখেতে পাবে না।
সারাবাংলা/জেএ/এমআই