দশম সংসদের সমাপ্তি, একাদশের কালগণনা শুরু
২৯ অক্টোবর ২০১৮ ২২:০৮
।। এমএকে জিলানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: শেষ হলো বহুল আলোচিত দশম সংসদ। সোমবার (২৯ অক্টোবরে) রাতে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে শেষ হলো এই সংসদ অধিবেশন। দশম সংসদের সমাপ্তির মাধ্যমে কার্যত একাদশ সংসদ নির্বাচনের কালগণনা শুরু হলো।
সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের ৩ দফার (ক) উপদফা অনুযায়ী, ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভাঙার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে।’ সেই হিসেবে একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দশম সংসদের অধিবেশন সোমবার রাতে শেষ হয়। তবে, কোনো বিশেষ কারণে সংসদ বসতে সংবিধান অনুযায়ী কোনো বাধা নেই।
২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি ছিল দশম সংসদের প্রথম দিন। এই সংসদে বিল পাস হয়েছে প্রায় দুইশ। সংসদে পাস ও উচ্চ আদালতে বাতিল হওয়া সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ছিল এ যাবৎকালে হওয়া সংবিধানের ১৭টি সংশোধনীর অন্যতম আলোচিত ঘটনা। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ সদস্যের নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে ‘অনুগত’ বিরোধীদল নিয়ে সরকার গঠন দশম সংসদের আরেক আলোচিত দিক।
এ সংসদের মোট অধিবেশ বসেছে ২৩টি, এর মধ্যে ৪১০ কার্যদিবস চলেছে। এতে ১৯৩টি বিল পাস হয়েছে। এর আগে নবম সংসদে ২৭১, অষ্টম সংসদে ১৮৫ এবং সপ্তম সংসদে ১৯১ বিল পাস হয়েছিল।
দশম সংসদে পাস হওয়া কয়েকটি আলোচিত আইনের মধ্যে রয়েছে— ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সম্প্রচার আইন, সড়ক পরিহন আইন ও সরকারি চাকরি আইন।
দশম সংসদে দুইবার সংবিধান সংশোধন হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। এতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা বিচার বিভাগ গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাত থেকে সংসদের কাছে ন্যস্ত করা হয়। যদিও হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের এই সংশোধনীকে অবৈধ হিসেবে রায় দিয়েছে। তবে, এই বির্তকের এখনও শেষ ফল আসেনি। কারণ আপিল বিভাগের রায়ের সর্বশেষ বিচারিক প্রক্রিয়া ‘রিভিউ’ করার সুযোগ আছে। যেটির ফয়সালা এখনও হয়নি।
ষোড়শ সংশোধনীতে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এটি উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ৩২৭-০ ভোটে পাস হয় এটি। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে হওয়া মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার পরই প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করেন।
চলতি বছরের ৮ জুলাই সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচনের বিধি আরও ২৫ বছর বহাল রাখার লক্ষ্যে সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী বিল পাস হয়। সংসদের ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ২৯৮-০ ভোটে বিলটি পাস হয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সংসদের প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টি উভয় বিলের পক্ষে ভোট দেয়। ফলে দুইটি সংবিধান সংশোধন বিলই সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।
দশম সংসদের বেশিরভাগ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় সমালোচনা যেমন আছে, তেমনি এই সংসদের একাধিক সংসদ সদস্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সংসদ সম্পর্কিত বিভিন্ন ফোরামে নেতৃত্ব দিয়ে দেশের সুনাম বাড়িয়েছেন।
এর মধ্যে ১৭৩টি দেশের সংসদ সদস্যদের সংগঠন ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঢাকা-৯ আসনের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী সরাসরি নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি আইপিইউয়ের দায়িত্ব পালনকালে বৃহৎ এই সংগঠনটির একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান বাংলাদেশে আয়োজন করেছেন।
অন্যদিকে ৫৬টি দেশের সংগঠন কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশনের (সিপিএ) নির্বাচনে ভোটে নির্বাচিত চেয়ারম্যান হন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনিও দায়িত্ব পালকালে বাংলাদেশে সিপিএ’র একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে অন্তত ২০টি দেশের স্পিকারসহ শতাধিক সংসদ সদস্য অংশ নিয়েছিলেন।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ও দশম সংসদের আলোচিত পার্লামেন্টারিয়ান ফখরুল ইমাম সোমবার বলেন, অংশগ্রহণের দৃষ্টিতে দেখতে গেলে দশম জাতীয় সংসদ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল সংসদ। তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, সরকারে থাকার কারণে হয়তো অনেকে আমাদের সমালোচনা করেন। কিন্তু এটা একটা পরীক্ষামূলক যাত্রা ছিল।
তিনি বলেন, সংসদ অধিবেশনে বিরোধীদলীয় নেতার ৭০ শতাংশ উপস্থিতি কেউ কল্পনাই করতে পারত না। কারণ আগের সংসদগুলোতে বিরোধী দলীয় নেতা তো দূরের কথা, বিরোধী দলই উপস্থিত থাকত না।
এর আগে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ। ওই সংসদে ক্ষমতাসীন দলটির দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। ফলে সংবিধানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ২০০৯ সাল থেকে টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা তার সরকার মোট তিন বার সংবিধানে সংশোধনী এনেছে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ১৭টি সংশোধনের মধ্যে সাতটি এসেছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। প্রথম চারটি এসেছিল বঙ্গবন্ধুর আমলে, তিনটি খালেদা জিয়ার আমলে।
জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া জাতীয় সংসদে বলেন, আমার দৃষ্টিতে দশম সংসদ একটি ফলপ্রসূ সংসদ। আমি ১৯৮৬ সালের পর থেকে সংসদে আছি। ওই সময়ের পর এবারের সংসদই সবচেয়ে প্রাণবন্ত কার্যক্রম চলেছে।
তিনি বলেন, ২০০১ সালে সংসদে বিরোধীদলকে প্রায় কথা বলতেই দেওয়া হয়নি। প্রায় দুইশ আইন প্রণয়নসহ সার্বিক কার্যক্রম বিবেচনায় দশম সংসদ অন্ত্যন্ত সফল।
সংসদীয় বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আইনের দৃষ্টিতে কোনো সমস্যা না থাকলেও ঐতিহ্যগত জায়গায় দশম সংসদ প্রশ্নবিদ্ধ।
তিনি বলেন, আইন মানুষ তৈরি করে, রীতি-নীতিও মানুষের কার্যক্রমের মাধ্যমে তৈরি হয়। কোনোটিরই মূল্যই কম নয়। আমি আশা করি, সবার অংশগ্রহণে আগামী সংসদ বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটবে।
গণপরিষদ থেকে শুরু করে বেশিরভাগ সংসদেই উপস্থিত আছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি সোমবার (২৯ অক্টোবর) সংসদ অধিবেশনে দশম সংসদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, সরকার ও বিরোধী দলের অংশগ্রহণে দশম সংসদ সফল সংসদ হিসেবে কাজ চালিয়েছে।
তিনি বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাস হচ্ছে সরকার ও বিরোধী দলের অংশগ্রহণে আন্তরিক পরিবেশে জনগণের কল্যাণে কাজ করা। এ সংসদে সেটাই হয়েছে।
সারাবাংলা/জেআইএল/এমএস/টিআর