মানবতাবিরোধী অপরাধ: দুই রাজাকারকে ফাঁসির রায়
৫ নভেম্বর ২০১৮ ১২:৩৫
।। সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে পলাতক দুই আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত সাতটি অভিযোগের সবগুলোই প্রমাণিত হওয়ায় এই সাজা দেওয়া হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনাল রায়ে জানায়।
বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সোমবার (৫ নভেম্বর) এ মামলার রায় দেন।
দণ্ডিত দুই আসামি হলেন হবিগঞ্জের লাখাই থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মো. লিয়াকত আলী। একাত্তরে তিনি ছিলেন স্থানীয় রাজাকার কামান্ডার। আর কিশোরগঞ্জের আমিনুল ইসলাম ছিলেন ওই এলাকার অাল-বদর বাহিনীর নেতা।
এর আগে সকাল পৌনে ১১টায় ৩১২ পৃষ্ঠার রায় পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম।
গত ১৬ আগস্ট এ মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শেষ হয়। শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল যে কোনো দিন রায় ঘোষণা করা হবে মর্মে সিএভি (অপেক্ষমাণ) রাখেন।
রায় ঘোষণার সময় চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুসহ প্রসিকিউশন টিমের সদস্যরা, তদন্ত সংস্থার প্রধান, এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সাক্ষি, রাষ্ট্র নিয়োজিত আসামিপক্ষের আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।
রায়ের পর এ মামলার প্রসিকিউটর রানা দাস গুপ্ত সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, ‘আসামিদের বিরুদ্ধে যে সাতটি অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল প্রসিকিউশন তার সবকটি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ট্রাইব্যুনাল এ দুই আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনটিকে ‘কালো আইন’ মন্তব্য করে রাষ্ট্র নিয়োজিত আসামিপক্ষের আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম বলেন, ‘আমি মনে করি প্রসিকিউশন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি। কারণ হলো, আসামি লিয়াকত আলী ১৯৭২ থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যদি অপরাধ করতেন তাহলে স্বাধীনতার পরপরই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হতো। কিন্তু এত বছরেও তা হয়নি।’
আসামি আমিনুল ইসলামের বেলায়ও একই ঘটনা। স্বাধীনতার এত বছর তার বিরুদ্ধে কোথাও কোনো মামলা হয়নি।
তামিম বলেন, ‘যেহেতু আসামিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি তাই প্রসিকিউশনের সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে। প্রসিকিউশনের সাক্ষ্য-প্রমাণে আসামিদের বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে বলে আমি মনে করি না। তারপরও ট্রাইব্যুনাল আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছে এই কালো আইনের অধীনে।’
কেন এটিকে কালো আইন বলছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ আইনটি এমন একটি কালো আইন যেখানে আসামিদের কোনো সুযোগ বা অধিকার দেওয়া হয়নি। এই অর্থে এটি কালো আইন।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতা শহীদ রঙ্গু মিয়ার ছেলে মো. মো. জুম্মান মিয়া এ মামলার তৃতীয় সাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন।
রায়ের পর জুম্মান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘রায়ে আমি এবং আমার পরিবার খুবই খুশি। ট্রাইব্যুনাল, প্রসিকিউশনের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি স্বাধীনতার এত বছর পর এই আসামিদের বিচার করার জন্য। সরকারের কাছে অনুরোধ জানাব, পলাতক আসামিদের ধরে তাদের সাজা কার্যকর করার জন্য। তবেই আমরা শহীদ পরিবার শান্তি পাব।’
আসামিদের বিরুদ্ধে সাত অভিযোগ
প্রথম অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি সেনা সদস্য ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে লাখাই থানার কৃষ্ণপুর গ্রামে গণহত্যা, লুটপাট। ওইদিন কৃষ্ণপুর গ্রামে নৃপেণ রায়ের বাড়িতে রাধিকা মোহন রায় ও সুনীল শর্মাসহ ৪৩ জন হিন্দুকে গুলি করে হত্যা।
দ্বিতীয় অভিযোগ: হবিগঞ্জের লাখাই থানার চণ্ডিপুর গ্রামে গণহত্যা ও লুটপাট।
তৃতীয় অভিযোগ: লাখাই থানার গদাইনগর গ্রামে গণহত্যা ও লুটপাট।
চতুর্থ অভিযোগ: অষ্টগ্রাম থানার সদানগর গ্রামে শ্মশানঘাটে হত্যা।
পঞ্চম অভিযোগ: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থানার ফান্দাউক গ্রামের বাচ্চু মিয়াকে অপহরণ এবং রঙ্গু মিয়াকে অপহরণ ও হত্যা।
ষষ্ঠ অভিযোগ: অষ্টগ্রাম থানার সাবিয়ানগর গ্রামে চৌধুরী বাড়িতে হামলা চালিয়ে হত্যা।
সপ্তম অভিযোগ: সাবিয়ানগর গ্রামে খাঁ বাড়িতে হত্যাকাণ্ড।
লিয়াকত ছিলেন রাজাকার বাহিনীতে: তদন্ত সংস্থার তথ্য অনুসারে, একাত্তরে লিয়াকত ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের ছাত্র ছিলেন। মুসলিম লীগের সদস্য হিসেবে ফান্দাউক ইউনিয়নে রাজাকার বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘদিন পালিয়ে থেকে লিয়াকত পরে এলাকায় ফেরেন এবং আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে এক সময় দলটির লাখাই থানা কমিটির সভাপতি হন বলে উল্লেখ করা হয়েছে অভিযোগপত্রে।
বর্তমানে তিনি ওই পদে নেই। মামলার তদন্তকালেই লিয়াকত পালিয়ে যান বলে প্রসিকিউশনের ভাষ্য।
রজব আলী ছিলেন আল বদরে: কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম থানার আলীনগর গ্রামের রজব আলী ১৯৭০ সালে ভৈরব হাজী হাসমত আলী কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় ইসলামী ছাত্র সংঘের কলেজ শাখার সভাপতি হন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ভৈরবে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে তিনি অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন এবং পরে এলাকায় ফিরে আল বদর বাহিনী গঠন করেন।
তদন্ত সংস্থা বলছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আটক হয়েছিলেন রজব। ১৯৭২ সালে তার বিরুদ্ধে দালাল আইনে তিনটি মামলাও হয়েছিল, যাতে তার যাবজ্জীবন সাজা হয়।
কিন্তু দালাল আইন বাতিলের সুযোগে ১৯৮১ সালে রজব ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত হন। পরে ‘আমি আল বদর বলছি’ নামে একটি বইও তিনি প্রকাশ করেন।
ওই বইয়ে রজবের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত অভিযোগের আত্মস্বীকৃতি রয়েছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়।
তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায়, ২০০৩ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত লিয়াকত আলী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। সভাপতি থাকা অবস্থাতেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১০ সালে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। এছাড়া একই ধরনের অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে রজব আলীর বিরুদ্ধে ওই সময়ে মামলা হয়।
২০১৬ সালের ১৮ মে এই দুজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল
সারাবাংলা/এজেডকে/একে
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দুই রাজাকার মানবতাবিরোধী অপরাধ