চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগে ‘আত্মঘাতী’ লড়াইয়ের শঙ্কা
১৩ নভেম্বর ২০১৮ ০৯:১১
।। রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম জেলার ১৬ আসনে নৌকা প্রতীকে লড়তে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন ২২৫ জন। গড়ে প্রতিটি আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ জন করে! দলটির নেতারাই বলছেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এত মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিল না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার জন্য এত প্রার্থীর মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা অশুভ প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটা আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতীও হতে পারে। যদিও দলটির চট্টগ্রামের নেতারা আশা করছেন, মনোনয়ন প্রত্যাশী যতজনই থাকুক, সবাই দলের প্রার্থীকে মেনে নেবেন।
চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মনোনয়ন প্রত্যাশী আছেন নগরীর কোতোয়ালী-বাকলিয়া (চট্টগ্রাম-৯) আসনে। এখানে মনোনয়ন প্রত্যাশী ২৬ জন। আসনটি চট্টগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার আসন হিসেবে বিবেচিত।
এরপর চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) ও চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীর সবচেয়ে সংখ্যা বেশি। বাকি ১৩টি আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীর ২০ জনের কম বলে সারাবাংলাকে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির সদস্য আরশেদুল আলম বাচ্চু। তিনি আরও জানান, চট্টগ্রাম-৬, ৭ ও ১৩ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা সবচেয়ে কম।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-সচেতন নাগরিক কমিটির চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট আকতার কবির চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই প্রতিযোগিতাকে আমি অশুভ প্রতিযোগিতা বলে মনে করি। সবাই নমিনেশন ফরম নিচ্ছেন। সবাই এমপি হতে চান। এটা রাজনীতির জন্য অশুভ সংকেত। দলের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। দলের মূল প্রার্থী যিনি হবেন, তার জন্য শুভ হবে না। যারা নমিনেশন পাবেন না, তারা স্যাবোটাজও করতে পারেন।’
মনোনয়নপত্র নেওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া দরকার ছিল বলে মনে করেন সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সদস্য সচিব বেদারুল আলম চৌধুরী বেদার।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রাণের সংগঠন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিক্রির ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ করা দরকার ছিল বলে মনে করি। এমন অনেকে ফরম নিচ্ছেন, যা রীতিমতো হাস্যকর। দলের প্রাথমিক সদস্য নন— এমন অনেকেও ফরম সংগ্রহ করছেন। উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী কারা হতে পারবেন, দলের সঙ্গে কতদিন সম্পৃক্ত বা পদ-পদবীতে আছেন তা যাচাই করে মনোনয়ন ফরম দিলে ভালো হতো।’
চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনের জন্য বর্তমান সংসদ সদস্য এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি গিয়াস উদ্দিন ও সদস্য মাহবুব উর রহমান রুহেল এবং ব্যবসায়ী নিয়াজ মোর্শেদ এলিটসহ ৯ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসন থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রার্থী এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম, প্রয়াত সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারের মেয়ে খাদিজাতুল আনোয়ার সনি, তরুণ আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব উল আলমসহ ২৫ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতাসহ ১৪ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড-কাট্টলী) আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য দিদারুল আলম, উত্তর জেলা যুবলীগের সভাপতি এস এম আল মামুন, কেন্দ্রীয় কৃষকলীগের সদস্য মোস্তফা কামাল, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল বাকের ভূঁইয়াসহ ১৭ জন মনোনয়ন পত্র সংগ্রহকরেছেন।
চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসন থেকে, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এ সালাম ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইউনূস গণি চৌধুরী, নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য মাহমুদ সালাহউদ্দিন চৌধুরীসহ ১০ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটনসহ চার জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসন থেকে সাবেক বন ও পরিবেশমন্ত্রী এবং বর্তমান সংসদ সদস্য মোহাম্মদ হাছান মাহমুদসহ চার জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসন থেকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ, সিডিএ চেয়ারম্যান মো. আবদুচ ছালামসহ ১৭ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) আসন থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, সিডিএ চেয়ারম্যান মো. আবদুচ ছালাম, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহসভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, পিপি অ্যাডভোকেট এম এ নাসের, কাউন্সিলর তারেক সোলায়মান সেলিম, কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাসান মনসুরসহ ২৬ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং) আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য ডা. আফছারুল আমিন, বিএনপির সাবেক মেয়র এম মনজুর আলম, নগর যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু এবং যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদসহ ১৬ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য এম এ লতিফ, নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন ও আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চুসহ ১৭ জন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন।
চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরী, যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বদিউল আলম, সাবেক সংসদ সদস্য চেমন আরা তৈয়ব, বিজিএমইএ নেতা মোহাম্মদ নাছিরসহ ৯ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা) আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য ও ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়শা খানসহ চার জন মনোনয়নপত্র নিয়েছেন।
চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ-সাতকানিয়া (আংশিক)) আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম চৌধুরী, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমানসহ ২৩ জন মনোনয়নপত্র নিয়েছেন।
চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য ড.আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি আবু সুফিয়ান, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরীসহ ১৮ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, দৈনিক পূর্বদেশের সম্পাদক মুজিবুর রহমান, শিল্পপতি আবদুল্লাহ কবির লিটনসহ ১২ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, মনোনয়নপত্র সংগ্রহকারীদের মধ্যে কয়েকজন আছেন যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একেবারেই সম্পৃক্ত নন। দলের তৃণমূলের কর্মী দূরে থাক, নেতারাই তাদের চেনেন না। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর আছেন, যিনি দু’টি আসন থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে খোদ নেতাকর্মীদের মধ্যে হাস্যরসের জন্ম দিয়েছেন। প্রথমবার ওয়ার্ড কাউন্সিলর হয়ে সংসদ সদস্যের মনোনয়ন চেয়েছেন— এমন ব্যক্তিও আছেন। আবার গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হেরে গিয়ে এবার সংসদ সদস্য হওয়ার আশায় মনোনয়নপত্র কিনেছেন— এমন সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরও আছেন।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন সারাবাংলায় বলেন, ‘অনেকে পত্র-পত্রিকায় নাম তোলার জন্য, নিজের স্ট্যাটাস বাড়ানোর জন্য মনোনয়নপত্র কিনেছেন। এটা বড় কোনে বিষয় নয়। দল যাদের মনোনয়ন দেবে, আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করে তাদের জিতিয়ে আনব।’
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান সারাবাংলা’কে বলেন, ‘দল যাকে নমিনেশন দেবে, সবাই তার পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে। এই ব্যাপারে আমরা কমিটেড।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর