যাই করুক যেন গুম না করে, ছাত্রদল নেতা সোহাগের পরিবারের আর্তি
১৮ নভেম্বর ২০১৮ ২৩:১৫
।। স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা : ‘রাত তখন আনুমানিক ২টা। বাড়ির সামনে গাড়ির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল সবার। দরজা খুলে দেখি আট-নয়জন ভর্তি একটি হায়েস গাড়ি। তারা সবাই গাড়ি থেকে নেমে আমাদের ঘরে ঢুকলো। হাতে ওয়ারলেস (ওয়াকিটকি) আর গাড়ির সামনে ডিবি লেখা দেখে বুঝেছি তারা পুলিশের লোক। তাই আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ঘরে ঢুকতে বাধা দেননি। ঢুকেই আমার খোঁজ করলো। আমি ভেতরের রুমে ছিলাম। সামনে রুমে আসতেই তারা জিজ্ঞেস করলো-তোমার ভাই কোথায়? বললাম-জানিনা। বললো- না জানলে তোমাকেসহ তোমার সব আত্মীয়কে থানায় নিয়ে যাব। আপাতত তুমি থানায় চলো। এটা বলে আমাকে থানায় আনলো। পরে সেখান থেকে আমাকে তাদের গাড়িতে করে ঢাকায় আনলো এবং আমার ভাইকে ধরল। কিন্তু তারপর থেকে ভাইয়ের আর কোনো খোঁজ পাচ্ছি না।’
এভাবেই শনিবার (১৭ নভেম্বর) রাতের বর্ণনা দিচ্ছিলেন সেলিনা ভূঁইয়া। রাজধানীর শাহজাহানপুর থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সোহাগ ভূইয়ার বোন তিনি।
গত ১৪ নভেম্বর নয়াপল্টনে পুলিশের উপর হামলা, গাড়ি ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলার আসামি সোহাগ। তাই তাকে ধরতে গতকাল (১৭ নভেম্বর) রাত আনুমানিক দুইটার দিকে তার বোনের শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে যান ডিবির সদস্যরা।
সেলিনার দাবি, রাত ৩টায় বাড়ি থেকে প্রথমে নাঙ্গলকোট থানা এবং পরে সেখান থেকে ডিবি পুলিশের গাড়িতে করে রাজধানীর যাত্রাবাড়ির শনির আখড়ায় আনা হয় তাকে। সেখানে সকাল ৭টার দিকে সোহাগকে পুলিশের হাতে তুলে দিলে ছাড়া পান সেলিনা ও তার সঙ্গে থাকা দেড় বছরের সন্তান সাদিয়া।
কিন্তু সোহাগকে গাড়িতে তুলে নিয়ে ডিবি পুলিশ চলে যাওয়ার পর দিনভর তার মা অজিফা বেগম ও বাবা সেলিম ভূঁইয়াসহ তারা দিনভর ডিবির প্রধান কার্যালয়ে অবস্থান করেও তার কোনো খোঁজ পান নি। সোহাগের পরিবারের দাবি, তিনি কোনো অপরাধ করলে শাস্তি হোক, জেল-জরিমানা হোক, কিন্তু তাকে যেন গুম করে ফেলা না হয়।
সেলিনা ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাত দুইটার তারা আমার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে আমাকে সোহাগের খোঁজ দিতে বলে। কিন্তু আমি যখন বললাম আমি জানি না সে কোথায় আছে। এটা বলার পর তারা আমাকে বিভিন্ন ধমকা-ধমকী করতে থাকে। সেই সঙ্গে তার খোঁজ না দিলে আমার বাবা-মা ও শ্বশুর শ্বাশুড়িকে জেলে দেবে এবং আমাকেও কোলের শিশুসহ সাত বছর জেল খাটতে হবে বলে ভয় দেখায়। এ অবস্থায় আমাকে জোর করে নাঙ্গলকোট থানায় নিয়ে যায় তারা। সেখানে প্রায় এক ঘন্টা নানান প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে রাত তিনটার দিকে আমাকে তাদের গাড়িতে করে ঢাকায় নিয়ে আসে। আমি বারবার অনুরোধ করলাম আমার কোলের বাচ্চা আমাকে নিয়েন না। কিন্তু তারা তা শুনলো না। কোলের বাচ্চাসহ আসতে হল। এরপর সকালে এসে শনির আখড়ার আমার এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের বাসা থেকে ভাইকে তাদের হাতে তুলে দিই। তারপর থেকে আর ভাইয়ের কোনো খোঁজ পাচ্ছিনা। যাই করুক, আমার ভাইটাকে যেন গুম না করে।’
সোহাগের মা অজিফা বলেন, ‘সোহাগ যদি কোনো অন্যায় করে তাহলে তাকে থানায় দিক। কিন্তু তাকে এভাবে লুকিয়ে রাখার মানে কী? আমরা সারাদিন ডিবি অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু তারা বললো সোহাগকে আনতে তারা দেখেনি। তাহলে কি আমার মানিককে ফিরে পাবো না!’
এরপর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এই মা।
তবে রাতে সেলিনাকে নাঙ্গলকোট থানায় নেওয়ার কথা কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নজরুল ইসলাম। সারাবাংলার প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঢাকা থেকে ডিবি পুলিশ এসেছে এমন খবর শুনেছি। কিন্তু কাউকে নিয়ে থানায় এসেছিল এ বিষয়ে কিছু জানি না। কারণ তারা কেউ থানায় আসেনি।’
পরে এবিষয়ে যোগাযোগ করা হয় ডিবির উপ-কমিশনার (পূর্ব) খন্দকার নুরুন্নবীর সঙ্গে। সোহাগকে আটকের বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি তার। তিনি বলেন, ‘তাকে আটক করা হয়েছে কিনা জানি না। তবে আটকের চেষ্টা চলছে।’
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মিশু বিশ্বাস বলেন, ‘ভিডিও ফুটেজ দেখে আমরা হামলাকারীদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি। এর মধ্যে সোহাগ অন্যতম। ঘটনার দিন সোহাগ গ্যাবাডিন প্যান্ট ও পাতা কালারের শার্টের বোতাম খোলা অবস্থায় লাঠি হাতে হামলা ও ভাংচুরে অংশ নেয়। এরপর থেকে পুলিশ তাকে খুঁজছিল। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে। কিন্তু আটক হয়েছে কিনা এখনও জানি না।’
উল্লেখ্য, গত ১৪ নভেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এসময় নেতাকর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে এবং তাদের দুটি গাড়িতে আগুন দেয়। পরে এ ঘটনায় পল্টন থানায় তিনটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। এসব মামলায় সোহাগ অন্যতম আসামি।
সারাবাংলা/এসএইচ/এসএমএন