এইডস প্রতিরোধে ‘৯০-৯০-৯০ লক্ষ্যমাত্রা’ অর্জন কতদূর?
১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৯:৩৫
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ৯০ শতাংশ সম্ভাব্য এইচআইভি আক্রান্তকে চিহ্নিত করা, চিহ্নিত ব্যক্তিদের ৯০ শতাংশকে চিকিৎসা সেবার আওতায় আনা ও চিকিৎসাধীনদের ৯০ শতাংশের ভাইরাসের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত রাখা- এই তিন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে জাতিসংঘের ‘ফাস্ট ট্র্যাক স্ট্র্যাটেজি’ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ।
২০৩০ সালের মধ্যে এইডস নির্মূল করতে ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী ও সমাজের মধ্যে এইচআইভি ভাইরাসের প্রভাব কমানোই এর লক্ষ্য। এর জন্য সরকার জাতীয় কৌশলপত্রও প্রণয়ন করেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘৯০-৯০-৯০ লক্ষ্যমাত্রা’র একটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কাজ সন্তোষজনক গতিতে এগিয়ে গেলেও বাকি দুইটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এখনও অনেক কিছু করার বাকি।
আরও পড়ুন: প্রবাসী শ্রমিকদের বয়ে আনা এইডস নিরীক্ষণের পথ নেই
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিদ্যমান তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে প্রায় ১৩ হাজার জন এইচআইভি আক্রান্ত রোগী থাকতে পারে। এর মধ্যে ৫ হাজার ৫৮৬ জনকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল (এনএএসসি) প্রোগ্রামের তথ্যও বলছে, ‘৯০-৯০-৯০ লক্ষ্যমাত্রা’র দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে অর্জন আশানুরূপ হলেও বাকি দুইটিতে প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্জন লাভ সম্ভব হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এইডস নির্মূল করতে সরকার ২০১৮-২০২২ মেয়াদি জাতীয় কৌশলপত্র প্রণয়ন করে কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। যদিও এখনও এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্তদের বেশিরভাগই এইডসের ওষুধ অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল (এআরভি) পাচ্ছেন না। আবার যারা ওষুধ পাচ্ছেন, তারা নির্ণয় যন্ত্রের অভাবে রক্তে ভাইরাসের উপস্থিতির মাত্রা সর্ম্পকে জানতে পারছেন না। এছাড়া, ‘৯০-৯০-৯০ লক্ষ্যমাত্রা’র প্রথম লক্ষ্য- ২০২০ সালের মধ্যে প্রতিটি দেশে এইচআইভি নিয়ে বসবাসকারী ৯০ শতাংশ মানুষকে শনাক্ত করার কাজটি অনেক দেশটি সফলভাবে করতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই শনাক্তের পরিমাণ অর্ধেকেরও কম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) স্ট্রেনদেনিং অব এইচআইভি সার্ভিসেস প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মেরিনা আখতার সারাবাংলাকে বলেন, প্রথম বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। গত বছর নতুন করে এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়েছে ৮৬৫ জন। সব মিলিয়ে দেশে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ৫৮৬ জন এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে শনাক্ত করা গেছে। কিন্তু ধারণা করা হয়, এর চেয়েও আরও বেশি রোগীকে শনাক্ত করা যায়নি।
ডা. মেরিনা জানান, ২০১৭ সালে এইডসে আক্রান্ত ১২৫ জন মারা গেছেন। আর এইডস শনাক্ত হওয়ার পর মারা গেছেন মোট ৯২৪ জন। দেশে এইডসে আক্রান্ত রোগীদের বেশিরভাগই ২২ থেকে ৪০ বছর বয়সী বলে জানান তিনি।
‘ক্রস বর্ডারে’র কারণে বাংলাদেশ এইডসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে বিএসএমএমইউয়ের এই চিকিৎসক বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষভাবে বলতে হবে ‘ইনজেক্টেবল’ মাদক ব্যবহারকারী, প্রবাসী শ্রমিক ও যৌনকর্মীদের কথা। এইডসে আক্রান্ত নারীর গর্ভের সন্তানও এইডস বহন করে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে ‘ইনজেক্টেবেল’ মাদকের ব্যবহারকারীরা। কেবল ছেলেরাই নয়, মেয়ে ও কিশোর-কিশোরীরাও এ ধরনের মাদক ব্যবহার করে থাকে।
আরও পড়ুন:বিশ্ব এইডস দিবস আজ
জানা গেছে, বর্তমানে বিএসএমএমইউ ছাড়াও সিলেট মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, খুলনা মেডিকেল কলেজ, ঢাকার সংক্রমণ ব্যাধি হাসপাতালেও এইচআইভি আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এছাড়া চলতি বছরের ২১ নভেম্বর কক্সবাজারের উখিয়াতেও এ সংক্রান্ত একটি সার্ভিস সেন্টার উদ্বোধন করা হয়েছে। এর বাইরে বেসরকারিভাবেও কয়েকটি সেন্টারে এইচআইভি পজিটিভ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এইডস প্রতিরোধে ‘৯০-৯০-৯০ লক্ষ্যমাত্রা’ অর্জনের বর্তমান চিত্র জানতে চাইলে ডা. মেরিনা আখতার বলেন, দ্বিতীয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের খুব কাছাকাছি আমরা আসতে পেরেছি। যেসব এইডস রোগীদের আমরা শনাক্ত করতে পারছি, তাদের প্রায় সবাইকে অ্যান্টি রেট্রোভাইরালের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে। তবে প্রথম ও তৃতীয় লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আরও কাজ করার সুযোগ রয়েছে। আমরা এখনও অনুমিত জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায় আনতে পারিনি। এখানে গণমাধ্যমেরও কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
ডা. মেরিনা আরও বলেন, তৃতীয় লক্ষ্যমাত্রাটি অর্জনের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। তবে সরকার ইতিবাচকভাবে কাজ করছে। এরই মধ্যে মেডিকেল কলেজগুলোতে রি-এজেন্ট, ভাইরাল লোড চলে গিয়েছে। এগুলোর পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলেই চিকিৎসাধীনদের ৯০ শতাংশের ভাইরাসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের কাজে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যাবে।
চিকিৎসকরা জানান, শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ (ভাইরাল লোড) জেনে এইডস রোগীদের চিকিৎসা দিতে হয়। বর্তমানে দেশে ভাইরাল লোড পরিমাপের যন্ত্র রয়েছে মাত্র দু’টি— একটি রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর), অন্যটি বিএসএমএমইউতে।
তবে ইইডিসিআর থেকে জানা যায়, তাদের যন্ত্রটি কেবল রক্তের নমুনাভিত্তিক জরিপের সময় ব্যবহার করা হয়। আর বিএসএমএমইউয়ের ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক সাইফ উল্লাহ মুন্সী জানান, রিএজেন্টের অভাবে তাদের যন্ত্রটি পড়ে রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এইচআইভি/টিভি ল্যাপসি প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার এইচআইভি ভাইরাসের পরীক্ষা বেশি হয়েছে। শনাক্তকারীদের চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসার হারও সন্তোষজনক। যাদের শরীরে এইচআইভি শনাক্ত করা যায়নি, তাদের তো আর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না।
দেশে ভাইরাল লোড পরিমাপের যন্ত্র মাত্র দুইটি। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ডা. সামিউল বলেন, আমাদের তো অত যন্ত্র দরকার নেই। যারা রোগী আছে, তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। ঘরে ঘরে তো আর পরীক্ষা করা হবে না। এটা নিয়ে নতুন প্রক্রিয়া চলছে। সেটা হয়ে গেলে এ বিষয়ে আরও দ্রুতগতিতে কাজ হবে।
এই চিকিৎসক আশাবাদ জানান, ২০৩০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব না হলেও এইডসকে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব হবে।
সারাবাংলা/জেএ/টিআর