মাদক-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রাজশাহীর তরুণ ভোটাররা
১৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৮:০২
।। সুমন মুহাম্মদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট ।।
রাজশাহী: ভোটের প্রচারণা জমজমাট। সব বয়সী ভোটারদের কাছে ছুটছেন প্রার্থীরা। বিশেষ করে তরুণ, অর্থাৎ নতুন ভোটারদের কাছে। সাধারণ সময়ে তাদের কথার তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না, বরং কখনও ধমক দিয়ে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয় এবং নায্য দাবির আন্দোলনেও লাঠিপেটা করানো হয়। অথচ এই তরুণ ভোটারদের মনোযোগ কাড়তেই এখন তাদের কাছে প্রতিশ্রুতি নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন বিভিন্ন দলের প্রার্থী।
সারাদেশের মতো রাজশাহীতেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের টার্গেট নতুন ভোটার। এইসব ভোটাররা যেমন প্রথমবারের মতো সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন বলে উচ্ছ্বসিত, তেমনি প্রার্থীরাও তাদের কাছে টেনে শোনাচ্ছেন দেশ গড়ার নতুন স্বপ্নের কথা। পাশাপাশি এটাও বলছেন, তাদের প্রতীকে ভোট না দিলে নতুন স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন হবে না। এমনকি জঙ্গি, যুদ্ধাপরাধীদের তৎপরতা বৃদ্ধি, গুম, খুন বেড়ে যাওয়ার ভয়ের কথাও বলে নিজ দলের প্রতীকে ভোট নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
তবে নতুন এই ভোটাররা বলছেন অন্য কথা। জঙ্গি, যুদ্ধাপরাধীদের তৎপরতা বৃদ্ধি, গুম, খুন যেমন চান না তারা, তেমনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাস, হলের সিট দখল, ছাত্র সংগঠনে নাম না লেখালে সিট না পাওয়া, সংগঠনের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য বাধ্য করা, নেতাদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলে মারধর— এসবও তারা চান না।
জাতীয় সংসদের প্রার্থীদের কাছে নয়া ভোটারদের চাওয়া, এসব বন্ধের নিশ্চয়তা দিতে হবে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন এলাকায় যে মাদক-সন্ত্রাস ক্রমশই বাড়ছে, তাও বন্ধ করতে হবে। আর এ সব বিষয়গুলোকে প্রার্থীদের নির্বাচনি ইশতেহারে মোটা দাগে নেওয়ার কথা বলছেন নতুন ভোটাররা।
জেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহীর ছয়টি আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ১৯ লাখ ৪২ হাজার ৫৬২ জন। দশম সংসদ নির্বাচনে এই সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৭ জন। সে হিসাবে এবার নতুন ভোটার হয়েছেন ১ লাখ ৯৯ হাজার ৯০৫ জন। এর মধ্যে নতুন পুরুষ ভোটার বেড়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৯১২ জন, নারী ৯৭ হাজার ৯৯৩ জন। এসব নতুন ভোটারের মধ্যে ৯০ ভাগ তরুণ-তরুণী, যারা প্রথমবার ভোটার হয়েছেন। বাকি ১০ ভাগ জেলার বাইরে থেকে আসা নাগরিক নতুনভাবে যুক্ত হয়েছেন ভোটার তালিকায়। নতুন ভোটারের অনেকেই জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্টকার্ড পাননি। তারপরেও ভোটার তালিকায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তারা ভোট দিতে পারবেন।
নতুন ভোটাররা বলছেন, নির্বাচনি প্রচারণা শুরুর পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী ও সমর্থকদের মুখে বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের নিয়ে বেশী আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। প্রার্থী বা সমর্থকদের পক্ষ থেকে দেশ উন্নয়নের কথা বলা হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাস বা মাদক নির্মূলের বিষয়গুলো সেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না। বরং বললে সবাই মিলে তা প্রতিহতের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। অথচ বিগত সময়গুলোতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হলে একে অন্যের ওপর দোষারোপ করে পরিস্থিতি এড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আবার মাদকবিরোধী কোনো অনুষ্ঠানে তা নির্মূল করার বিষয়ে জোরালো বক্তব্য রেখে পরে সে বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখা হয়নি।
তরুণ ভোটাররা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তির দিক থেকে দেশ অনেক এগিয়েছে। তবে তার অপব্যবহারও বেড়েছে। যার কারণে বাড়ছে সামাজিক অপরাধও। আগামীতে এসব প্রতিরোধের ব্যাপারেও কার্যকর ভূমিকা রাখার অঙ্গীকার দিতে হবে। আর এসবের পাশাপাশি যে দল সরকার গঠনের পর কর্মসংস্থান ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে, তারা সে দলের প্রার্থীকেই ভোট দেবেন।
রাজশাহীর তরুণ সংগঠন ইয়ুথ অ্যাকশন ফর সোস্যাল চেঞ্জেস-এর সভাপতি শামীউল আলীম শাওন বলেন, তরুণদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাদকমুক্ত সমাজ গড়ে তোলাসহ এলাকার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবেন— এমন প্রার্থী বেছে নেওয়া হবে। শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে তরুণদের জন্য রাজশাহী অঞ্চলকে সুন্দর করার জন্য যেসব প্রার্থী ভাববেন, তাদের পক্ষেই অবস্থান থাকবে তাদের।
রাজশাহী নিউ গভমেন্ট ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী হাসনা বানু সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছি। এ জন্য খুবই খুশি আমি। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিগত সময়ে যেসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটেছে, আগামীতে যেন সেগুলো বন্ধ হয়, সে বিষয়ে প্রার্থীদের অঙ্গীকার করতে হবে— এটাই আমার দাবি।’
গোদাগাড়ী প্রেমতলী ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী বেলাল হোসেন বলেন, এলাকায় মাদক নির্মূলের ব্যাপারে কেবল প্রতিশ্রুতি নয়, যে প্রার্থী তার নির্বাচনি ইশতেহারে অঙ্গীকার করবেন, তাকেই বেছে নেবেন তিনি। সেইসঙ্গে তরুণদের কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের সুযোগের পরিধি বাড়িয়ে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেবেন যিনি, তাকেই তিনি এই নির্বাচনে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করতে চান।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী জুয়েল আহম্মেদ বলেন, নতুন ভোটার হিসেবে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এবার জাতীয় নির্বাচনে প্রথম ভোট দেবো। আমার চাওয়া, প্রার্থীরা তরুণদের কর্মসংস্থান করবেন। তবে তা হতে হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে, কোনো ধরনের অনৈতিক লেনদেন যেন এর সঙ্গে যুক্ত না হয়।
রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে গত ১০ বছরে এলাকারও অনেক উন্নয়ন হয়েছে। সেইসঙ্গে অবৈতনিক লেখাপড়া সুযোগ পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ থাকায় তারা জ্ঞানার্জনের সুযোগ পাচ্ছে। আগামীতে আরও এই ধরনের সুযোগ বাড়বে, সেই বিষয়গুলো নতুন ভোটারদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, শুধু তাই নয়, দেশের উন্নয়নে আগামীতে কী পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের, সেই বিষয়গুলো উত্থাপন করা হচ্ছে তাদের সামনে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাস আগের মতো হয়নি গত ১০ বছরে। বরং যারা এমন কর্মকাণ্ড চালানোর চেষ্টা করেছে, তাদের প্রতিহত করা হয়েছে— দাবি করেন আসাদুজ্জামান আসাদ।
তিনি আরও বলেন, মাদক নির্মূলের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকার জিরো টলারেন্সের ঘোষণা অনেক আগেই দিয়েছে। সে বিষয়ে এরই মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। নৌকা প্রতীক বিজয়ী হলে আরও জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে সরকার অগ্রণী ভূমিকা রাখবে— আমরা আমাদের দলের এই বার্তা তরুণ ভোটারদের কাছে পৌঁছে দিতে চাই।
জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন বলেন, ‘তরুণ-তরুণীরা লেখাপড়া শেষ করে যেন কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়, সেসব পরিকল্পনার কথা তাদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। কারণ তারাই ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনায় বড় ভূমিকা পালন করবেন। তাই তাদের চিন্তা-চেতনাগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয় বিবেচনায় রয়েছে। ধানের শীষ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে মাদক ব্যবসা বন্ধের ব্যাপারে জোরালে ভূমিকা রাখবেন বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্য, এটা আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য।’
সারাবাংলা/একে/টিআর