ভোটের উৎসবমুখর পরিবেশ দেখছে আ.লীগ, শঙ্কা বিএনপির
১৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৫:৫৬
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: নির্বাচনের আগে রিটার্নিং অফিসারদের আহ্বানে এক টেবিলে বসেছিলেন চট্টগ্রামের প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থী। এসময় বিভিন্ন অভিযোগ তুলে বিএনপির প্রার্থীরা বলেছেন, ভোটারদের মনে শঙ্কা বিরাজ করছে। আর আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বলেছেন, চট্টগ্রামে উৎসবমুখর নির্বাচনের পরিবেশ আছে। অন্যান্য প্রার্থীদের কেউ সুন্দর পরিবেশের কথা বলেছেন, আর কেউ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন।
সোমবার (১৭ ডিসেম্বর) সকালে চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের প্রার্থীদের সঙ্গে পৃথকভাবে মতবিনিময় করেন দুই রিটার্নিং অফিসার বিভাগীয় কমিশনার মো. আব্দুল মান্নান এবং জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন।
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড-কাট্টলী), চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী), চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও), চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া), চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-হালিশহর) এবং চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা বিভাগীয় কমিশনার।
বাকি ১০টি আসনের প্রার্থীদের সঙ্গে নিজ কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে মতবিনিময় করেছেন জেলা প্রশাসক।
বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসনের বিএনপির প্রার্থী আবু সুফিয়ান বলেন, ‘আমার নির্বাচনি এলাকা চান্দগাঁওয়ের পাঁচটি ওয়ার্ডে নারকীয় তাণ্ডব চলছে। প্রতিদিন রাতে পুলিশ যাচ্ছে। বাড়িঘরে হামলা হচ্ছে, নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। আমরা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই।’
মতবিনিময় সভায় ডবলমুরিং-হালিশহর আসনের বিএনপির প্রার্থী আবদুল্লাহ আল নোমান নগরীর নয়াবাজারে বিজয় দিবসের র্যালিতে হামলার অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাকে গুলি করার জন্য উদ্যত হয়েছিল। পত্রিকায় এসেছে কিনা জানি না, তবে আমার কাছে ছবি আছে। আমি পুলিশের কাছে জীবন বাঁচানোর জন্য আবেদন করেছিলাম। একঘণ্টা পর পুলিশ এসে আমাদের উদ্ধার করে।’
তিনি বলেন, ‘আমার পোস্টার-ব্যানার কেটে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। শুধু আওয়ামী লীগের কর্মীরা করছে সেটা বলছি না, পুলিশও ধানের শীষের পোস্টার-ব্যানার দেখলে কেটে ফেলে দিচ্ছে। নির্বাচন করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। মানুষের মধ্যে শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ছে। পুলিশে একটু অদল-বদল করেন। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠান।’
বন্দর-পতেঙ্গা আসনের বিএনপির প্রার্থী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘অস্বীকার করা যাবে না, এই মুহূর্তে একটা ভয়ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে প্রশ্ন, ভোট দেওয়া যাবে কি-না ? বিএনপির নেতাকর্মীদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে- এলাকা ছেড়ে চলে যাও। গায়েবি মামলা দেওয়া হচ্ছে। ৩০ তারিখের আগেই যেন সব বিচার শেষ করে ফেলা হবে!’
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা কেন পার্টি হচ্ছেন? আমরা তো আপনাদের সম্মান করি, আপনাদের বিশ্বাস করি। আপনারা কেন রাজনৈতিক দলের পক্ষ নেবেন? দয়া করে গ্রেফতার অভিযানটা বন্ধ করুন।’ এসময় ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে প্রার্থীর সব প্রতিনিধির সামনে ব্যালট বাক্স ভোটারের সংখ্যা অনুযায়ী গণনা করে নেওয়ার প্রস্তাব করেন আমীর খসরু।
আমীর খসরুর বক্তব্যের পর কোতোয়ালী-বাকলিয়া আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘বিএনপির প্রার্থীরা ভোটারদের মধ্যে ভয়ভীতি থাকার কথা বলছেন। আমার নির্বাচনি এলাকায় তো আমি ভোটারদের মধ্যে কোন ভয়ভীতি দেখছি না। এলাকায় সব প্রার্থীর পোস্টার আছে। ২০০৫ সালের নির্বাচনে (সিটি করপোরেশন নির্বাচন) গুলি করে শ্রমিক লীগের ৬ জন নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আমরা তো ভয়ভীতির কথা বলে নির্বাচন থেকে সরে যাইনি।’
‘আসলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহতের নামে ওনারা যে তাণ্ডব চালিয়েছিলেন, ৫০০ লোককে পুড়িয়ে হত্যা করেছিলেন, মানুষের মধ্যে ভয় থাকলে সেজন্যই আছে। এছাড়া যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি দল এখন বিএনপির সঙ্গে মিশে গেছে। সেজন্যও মানুষের মধ্যে ভয় আছে।’
নওফেল এই বক্তব্য দেওয়ার সময় আমীর খসরু প্রতিবাদ করে বলেন, ‘এসব রাজনৈতিক বক্তব্য। এটা রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়ার জায়গা নয়।’ নওফেল বলেন, ‘আপনারা রাজনৈতিক অভিযোগ আনতে পারলে আমরা কেন বলতে পারব না?’
রিটার্নিং অফিসার আব্দুল মান্নান প্রসঙ্গ পাল্টানোর অনুরোধ করলে নওফেল বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে অপপ্রচার হচ্ছে। বিশেষ করে নারীদের বলা হচ্ছে, ইভিএম নাকি খুব কঠিন। এটাতে ভোট দিলে নাকি একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রার্থীই শুধু জিতবেন। এই অপপ্রচার বন্ধে নির্বাচন কমিশনকে পদক্ষেপ নিতে হবে।’
একই আসনে বিএনপির প্রার্থী কারাবন্দি ডা. শাহাদাত হোসেনের প্রতিনিধি এস এম বদরুল আনোয়ার প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ইভিএম’র পাশাপাশি ব্যালট পেপারও রাখার প্রস্তাব করেন।
বিএনপির প্রার্থীদের অভিযোগের প্রসঙ্গ টেনে বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসনের নৌকা মার্কার প্রার্থী মঈনউদ্দিন খান বাদল বলেন, ‘মতের ভিন্নতা নিয়েই তো আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে এসেছি। তারা বলবে নির্বাচনের পরিবেশ নেই। আমরা বলব, আছে। তারা বলবে মানুষের মধ্যে ভয়ভীতি আছে। আমরা বলব, নেই। প্রার্থীর সঙ্গে প্রার্থীর এই মতভিন্নতা না থাকলে আমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে নির্বাচন করছি কেন?’
তিনি বলেন, ‘আমরা যারা প্রার্থী, আমাদের প্রতিদিন একজনের সঙ্গে আরেকজনের দেখা হবে। আমরা বাঙালি। এই বাঙালিদের দেশ একটাই। সুতরাং একটা নির্বাচনের কারণে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে না।’
তবে বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে একজন চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনের এনামুল হক এনাম বলেছেন, ‘তিনি এলাকায় কোন বাধা পাচ্ছেন না। নির্বিঘ্নে প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারছেন।’
হাটহাজারী আসনে মিনার প্রতীকের প্রার্থী মাঈনুদ্দিন রুহী বলেন, ‘সারাদিন ভোট দেওয়ার পর রাতে যাতে ফলাফল পাল্টে না যায়, সেটার ব্যবস্থা করতে হবে।’
চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনে সিপিবি’র প্রার্থী মো. সেহাবউদ্দিন অভিযোগ করেন, শনিবার (১৬ ডিসেম্বর) প্রচারণা চালানোর সময় ১০০-১৫০ জন যুবক মোটর সাইকেলে শোডাউন করে তাদের কাছাকাছি এসে উসকানিমূলক বিভিন্ন স্লোগান দেন। এসময় ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় তিনি প্রচারণা না চালিয়ে ফেরত আসতে বাধ্য হন। নির্বাচন কমিশনের কাছে নিরাপত্তা দাবি করেছেন সেহাবউদ্দিন।
দুই রিটার্নিং অফিসার প্রার্থীদের অভিযোগ শোনেন এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিকারের আশ্বাস দেন। তারা প্রার্থীদের আচরণবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। মতবিনিময় সভায় আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, রেঞ্জ, জেলা ও নগর পুলিশের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তারাও বক্তব্য রাখেন।
সারাবাংলা/আরডি/এমও