রাজশাহীতে ভোটের প্রচারণায় শুধু উন্নয়নের ফিরিস্তি
১৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:৩৯
।। সুমন মুহাম্মদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট ।।
রাজশাহী: প্রার্থীদের রাস্তায় চলার পথে ভোট চাওয়া। দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে লিফলেট বিতরণ। এলাকায় এলাকায় ক্ষুদ্র মিছিল। সমাবেশে প্রতিশ্রুতি আর উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরা। মাইকিংয়ে গান, নানা স্লোগান।
এই সব মিলিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজশাহীতে চলছে জমজমাট প্রচারণা। আর এই প্রচারণার বড় অংশ জুড়ে ঠাঁই পেয়েছে উন্নয়ন যুদ্ধ। প্রার্থী ও দলের নেতাকর্মীদের ধারণা ক্ষমতায় থাকাকালীন যে সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করা হয়েছে তা সামনে রেখে ফের নির্বাচনে জয়ী হতে পারবেন। ভোটারদের কাছে ব্যাপক প্রচার করলে আওয়ামী লীগকে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আনতে সমর্থন দেবে। বিএনপিও ঠিক এমনটি ভাবছে তাদের আসনগুলো পুনরুদ্ধার হবে তাদের আমলে করা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রচার করলে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুদলই এখন সরগরম। তাইত আওয়ামী লীগ ট্রামকার্ড হিসেবে সামনে রাখছে গত দশ বছরের উন্নয়ন। অন্যদিকে বিএনপি ট্রামকার্ড হিসেবে সামনে রাখছে তাদের শাসনামলে করা উন্নয়ন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারসহ বিভিন্ন বিষয়।
রাজশাহীর ছয়টি আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তথা ঐক্যজোটের মনোনীত ছয় প্রার্থী থাকলেও দু’দলের নতুন প্রার্থী রয়েছেন তিনজন। এর মধ্যে বিএনপি থেকে রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনুপর) আসনে শফিকুল হক মিলন ও রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনে আবু সাঈদ চাঁদ এবং আওয়ামী লীগ থেকে রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দূর্গাপুর) আসনে আছেন ডা. মনসুর রহমান। এরা বাদে এই দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা কেউ একবার, কেউ দুবার আবার কেউ তিনবার সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে এমন নয়জন প্রার্থী ভোটারদের সামনে তুলে ধরছেন তাদের আমলে করা এলাকার উন্নয়ন চিত্র।
ভোটাররা বলছেন, ভোর থেকে রাত অবধি প্রার্থী ও সমর্থকরা যেমন ভোট চাচ্ছেন তেমনি আগামী দিনের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত করছেন। এরপর দুপুর থেকে মাইকিংয়ের মাধ্যমে চলছে উন্নয়নের জোর প্রচারণা। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা গেলো দশ বছরে কী কী উন্নয়ন করেছেন তার বর্ণনা দিয়ে চলেছেন।
ঠিক তেমনি বিএনপি সেই ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত কী কী উন্নয়ন করেছে সেই ফিরিস্তি তুলে ধরছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে এবারের নির্বাচনে চলছে উন্নয়নযুদ্ধ। শুধু কি তাই মাইকের প্রচারণায় ধর্মীয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে গোরস্থানে পর্যন্ত কত টাকা বা কী বরাদ্দ দিয়েছেন সেই প্রচারণাও চালানো হচ্ছে।
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের নির্বাচনে কেবল উন্নয়ন বা আগামী দিনের উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পার পাওয়া অনেকটাই মুশকিল হবে প্রার্থীদের জন্য। দলীয় ভোটারের বাইরেও এবার নতুন ভোটাররা একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে। এ ছাড়া বরাবরের মতো বস্তিবাসীর ২০ হাজার, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২৯ হাজার, উর্দু ভাষাভাষীর (বিহারি) প্রায় ১৫ হাজার ভোট নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে একটা বড় ভূমিকা রাখবে।
রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনে আওয়ামী লীগের ওমর ফারুক চৌধুরী এমপি টানা দুইবার ক্ষমতায় রয়েছেন। বিএনপির সাবেক ও ডাক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক টানা তিনবার এমপি ছিলেন।
রাজশাহী-২ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ফজলে হোসেন বাদশা টানা দুইবারের এমপি। বিএনপির সাবেক মেয়র ও এমপি মিজানুর রহমান মিনু দীর্ঘ ১৬ বছর মেয়র ছিলেন। সেই সঙ্গে একবার এমপির দায়িত্ব পালন করেছেন।
মহানগরীর সাগরপাড়া এলাকার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এরশাদ পতনের পর থেকেই রাজশাহীর সামগ্রিক উন্নয়নে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকার কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। তবে এটা ঠিক কোন সরকারের আমলে কম হলেও অন্য সরকারের আমলে বেশি হয়েছে। উন্নয়ন সরকারের নিয়মতান্ত্রিক ব্যাপার। তবে ১৯৭৫ সালের পর রাজশাহীতে কর্মসংস্থানের জন্য পৃথক কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত কোনো সরকার করতে পারেনি। যা এই জেলা বা অঞ্চলের জন্য একটা বড় সমস্যা। তাই কেবল উন্নয়নের কথা বললেই হবে না। এই অঞ্চলের জন্য পৃথক কোন বড়ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে কিনা প্রার্থীদের কাছে এই ধরনের প্রতিশ্রুতি কামনা করছি।’
মহানগরীর কাজিহাটা এলাকার জাওহার আলী বলেন, ‘রাজশাহীকে শিক্ষার মহানগরী বলা হলেও দীর্ঘ ৪০ বছরেও মাধ্যমিক বা প্রাথমিক পর্যায়ে ভালোমানের কোনো সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। যার কারণে প্রতিবছর পিএন গালর্স স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল ও ল্যাবরেটরি স্কুলে সন্তানদের ভর্তির জন্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে অভিভাবকদের। প্রার্থীদের ঘোষণায় বিভিন্ন স্কুলের নতুন ভবন নির্মাণের কথা, এমনকি কী পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তা প্রচার করা হলেও নতুন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পেরেছেন কি না তা বলতে পারছেন না। আগামীতে নতুন কোনো প্রাথমকি ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারবে কি না সেই বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা কামনা করা হচ্ছে।’
রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনে আওয়ামী লীগের আয়েন উদ্দিন টানা দুইবারের এমপি। বিএনপির শফিকুল হক মিলন এবার প্রথমবারের মত নির্বাচন করছেন।
পবার দুয়ারি মোড় এলাকার আব্দুল খালেক বলেন, ‘এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় যেন বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উন্নয়নের পার্থক্য তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। এলাকার মানুষকে জানানোর চেষ্টা করছেন কারা আসলে কতটুকু উন্নয়ন করেছে। যার মাধ্যমে আগামীতে ভোট পেয়ে নির্বাচিত হতে পারেন। অথচ এলাকায় বহু সমস্যা রয়েছে যেগুলোর উন্নয়ন সাধন হলে জনগণ উপকৃত হবে। উল্লেখ করা যেতে পারে খরা মওসুম শুরু হলেই জমির ফসলে সেচ দেওয়া নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। অথচ এলাকার খাল-বিলগুলো খনন করলে এই সমস্যার সমাধান হবে। দীর্ঘদিন থেকে নির্বাচিত এমপিদের বলা হলেও আমলে নেন না। এমনকি গ্রামের মধ্যে অনেক রাস্তা সংস্কারের অভাবে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে তার উন্নয়ন হয় না। অথচ প্রার্থীদের প্রচারিত ফুলঝুরিতে মনে হচ্ছে এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।’
রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনে আওয়ামী লীগের প্রকৌশলী এনামুল হক টানা দুইবারের এমপি। বিএনপির আবু হেনা টানা দুইবার এমপি ছিলেন।
রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনে আওয়ামী লীগের ডা. মনসুর রহমান এবার প্রথম নির্বাচন করলেও বিএনপির নাদিম মোস্তফা টানা দুইবার এমপি ছিলেন।
রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) আসনে আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম টানা দুইবরের এমপি হলেও বিএনপির আবু সাঈদ চাঁদ এবার প্রথমবারের মত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধিন মহাজোট সরকারের আমলে রাজশাহীর ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তবে কোন এলাকায় কেমন উন্নয়ন হয়েছে তা সাধারণ ভোটাররা জানেন না। তাই বিভিন্ন পন্থায় এলাকার মানুষের কাছে উন্নয়নের বার্তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। যাতে এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে আবার নির্বাচিত করেন এবং এলাকার উন্নয়ন করার সুযোগ করে দেন।
তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন একটি চলমান পক্রিয়া। আগামীতে রাজশাহীতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করার পরকিল্পনা আওয়ামী লীগের রয়েছে। সরকার গঠন করলে অবশ্যই তা করা হবে।’
মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, ‘বিএনপি সরকার যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই রাজশাহীর অজপাড়াগাঁতেও বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়েছে। যার সুফল মানুষ এখনও পায়। সেই বিষয়গুলো আবারও ভোটারদের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে। শুধু তাই নয় বিএনপি সরকারের আমলে গৃহীত অনেক প্রকল্প এই সরকার ফাইলবন্দি করে তা বাস্তবায়ন করেনি। জনগণের সামনে প্রচারণার মাধ্যমে তা তুলে ধরা হচ্ছে।
সারাবাংলা/একে/পিএ