বিশ্বাসই করবো না আপনি নেই
২০ ডিসেম্বর ২০১৮ ১১:২৮
মাসুম রেজা ।।
আপনার সাথে পরিচয়ের সূত্র ছিলো সালাউদ্দিন লাভলু। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। তখন কেবল আপনার নাম জানতাম। পুনে ফিল্ম ইনিস্টিটিউট থেকে চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়াশুনে করে আসা সফল ফিল্ম-এডিটর সাইদুল আনাম টুটুল। ভারতের বিখ্যাত পরিচালক ডেভিড ধাওয়ানের চেয়েও বেশী মার্কস পেয়ে আপনি উত্তীর্ন হয়েছেন ফিল্ম স্টাডিজ কোর্স। আপনার সাথে পরিচয়ের আগেই আপনি চিত্র-সম্পাদনায় দু’টো জাতীয় পুরস্কারও পেয়ে গেছেন। সেদিন আপনার সাথে পরিচিত হতে পেরে কী যে ভালো লেগেছিলো টুটুল ভাই। আমার চোখের ভাষা আপনি সেদিন নিশ্চয় পড়তে পেরেছিলেন। আর তাইতো মূহুর্তেই আমাকে আপন করে নিলেন।
আপনি লাভলুর কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন আমার নাটক লেখার কথা। আমার লেখা লাভলুর পরিচালনায় কৈতব নাটকটা আপনি দেখেও ছিলেন। তাইতো প্রথম দিনেই আপনি আমার কাছে স্ক্রিপ্টের কথা বললেন। বললেন একটা লিখে ফেলো মাসুম। আপনিতো চলচ্চিত্রের মানুষ টিভি নাটকে এসেছেন প্যাকেজ নাটক প্রচলেনর কারণে। আহমেদ ইউসুফ সাবেরের লেখা গল্প নিয়ে কেবল তৈরী করেছেন ‘সুখের নোঙ্গর’। আমরা সবাই বসে নাটকটা দেখলাম। অভিভূত হলাম। সেদিন সবাই মিলে একবাক্যে বলেছিলাম সুখের নোঙ্গর-এর ফরমেটটা টিভি নাটকের কিন্তু আসলে এটা একটা চলচ্চিত্র। গল্প বলার ধরণ থেকে শুরু করে চিত্রনাট্য, সংলাপ আর শটের আদল সবই চলচ্চিত্রের। সাগর পাড়ের মানুষের জীবন ও সংগ্রামকে উপজীব্য করে আপনি বানালেন সুখের নোঙ্গর। সেই নাটকে আপনি জেলে সম্প্রদায়ের প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে দেখালেন সাম্পান ধর্মঘট। সেখান থেকেই আমি শিখেছিলাম নাটকের গল্পে মানুষের জীবন ও জীবিকার ছায়া দেখাতে হবে, দেখাতে হবে অভিনব কোনো ঘটনা যা দর্শককে চমকে দেবে। আমার সব নাটকেই এরকম কিছু একটা করার চেষ্টা আমি এখনো করি। যে চলচ্চিত্রের জন্যে আমি দু’টো জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি সেই ‘বাপজানের বায়োস্কোপে আমি ‘লবন সঙ্কট’ দেখিয়ে ছবির কাহিনিকে নিয়ে গেছি অন্য এক মাত্রায়। যে কৌশল আমি আপনার কাছে শিখেছি। আপনার জন্যে আমি লিখলাম ‘সেকু সেকান্দার’ আমার দ্বিতীয় টিভি নাটক। আপনারও দ্বিতীয় টিভি নাটক। নির্মাণের দিক দিয়ে সেকু সেকান্দার এক ধ্রুপদ অবস্থানে আছে। আলী যাকের, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, তানিয় আহমেদ, কামাল আহমেদ-এর কাছ থেকে আপনি যে অসাধারণ অভিনয় আদায় করে নিলেন তা কক্সবাজারে নাটকটার শুটিংকালে আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি। এবং শিখেছি। সালাউদ্দিন লাভলু ছিলো নাটকটার চিত্রগ্রাহক। আমার বিশ্বাস লাভলুও আপনাকে শিক্ষক হিসেবেই মেনে চলবে চিরদিন। আপনার মৃত্যুকালে লাভলু সারাটা সময়ই আপনার কাছাকাছি ছিলো তার কৃতজ্ঞতার সবটুকু নিয়ে।
আরও পড়ুন : লন্ডনে শেষ হলো ‘গণ্ডি’র কিছু অংশের শুটিং
আপনি আমার আরো অনেকগুলো নাটক করলেন সেকু সেকান্দর-এর পরপরই। অষ্টমাদল, অদিতা, ১৯ এপ্রিল, আনন্দনগর। মনে পড়ে গিয়াস উদ্দিন সেলিম’র ‘দক্ষিণের জানালা’র কথা। যুবদা (খালেদ খান) অভিনয় করলেন তাতে। একটা দৃশ্য প্রায় দশ মিনিটের। একই শটে। কোনো কাটাকাটি নেই। যুবদাও ছিলেন দাপুটে অভিনেতা। দু একবার ভুল করার পরে দশ মিনিট ধরে জনান্তিকে সংলাপ বলে গেলেন তিনি। দক্ষিণের ঘর-এর সেই দৃশ্যটা আমার কাছে বাংলা টিভি নাটকের সবচেয়ে ভালো দৃশ্য। ‘নাল পিরান’ করলেন এরপর। আনিসুল হক-এর লেখা নাটক। ঐ নাটকে আপনি আপনার টেবিল ওয়ার্ক করলেন বেশ দীর্ঘ একটা সময় নিয়ে। তারপর রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় রূপান্তর করালেন একজনকে দিয়ে। আর আপনার নির্মাণের ধারা অনুযায়ী মহড়া করলেন বেশ কয়েকদিন। নাটকটার প্রিমিয়ার হলো রংপুর টাউন হলে। আমার মনে আছে সে এক বিশাল বহর নিয়ে আপনি রংপুর গিয়েছিলেন। আমি, জয়ন্ত দা, আনিসুল হক, গিয়াস উদ্দিন সেলিম, শিরিন খান মনিসহ আরো অনেকে।
টিভি নাটককে আপনি চলচ্চিত্রের মর্যাদা দিতেন, দিতেন আপনার অন্তরের নিবেদন। বৃন্দাবন দাস আজকের সফল ও জনপ্রিয় নাট্যকার। তার প্রথম নাটক আপনি নির্মাণ করেছিলেন। ‘বন্ধুবরেষু’। সাত পর্বের ধারাবাহিক। মূল চরিত্রে ছিলো লাভলু। এক নাটকই বৃন্দাবনকে এনে দিয়েছিলো তারকাখ্যাতি। আপনি কেবল নির্মাণ করেননি টুটুলভাই, তৈরী করেছেন অসংখ্য তারকা। তাদের অনেকের নামই ইতিমধ্যে বলে ফেলেছি। এরপর এলো আপনার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের সময়। আধিয়ার। সেলিমের স্ক্রিপ্ট। আপনি আমাকে নিয়ে কক্সেসবাজার গেলেন স্ত্রিপ্টের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে ঘষামাজা করার জন্যে। একটানা ছয়দিন আপনার সাথে হোটেল সাইমনের একটা ঘরে বসে কাজ করলাম। সেই দিনগুলোর কথা কোনোদিনই ভুলবো না টুটুল ভাই।
কাজের ভিতরে ডুবে থাকার যে অনন্য দৃষ্টান্ত আপনি আমাকে দেখিয়েছেন তা কি ভোলা যায়? আপনার সাথে কত কত স্মৃতি। সেইসব স্মৃতি আপনাকে আমার ভিতরে জীবন্ত করে রাখবে আজীবন। আমার সেকু সেকান্দার নাটকের শেষ সংলাপটা ছিলো ‘বিশ্বাস করবো না’। আজ আপনার জন্যে সেই শেষ সংলাপটাই একটু বাড়িয়ে লিখলাম ‘বিশ্বাসই করবো না আপনি নেই’।
মাসুম রেজা : খ্যাতিমান নাট্যকার ও লেখক। সভাপতি, নাট্যকার সংঘ।
আরও পড়ুন :
. এশিয়ান ফিল্ম স্কুলে দেশের দুই তরুণ
. শুক্রবার দেশে আসবে আমজাদ হোসেনের মরদেহ
. নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকের কাজ শুরু : শ্যাম বেনেগাল
মাসুম রেজা সাইদুল আনাম টুটুল সালাউদ্দিন লাভলু সেকু সেকান্দার