ঢাকা ৬: শরিক দলে ভরসা প্রধান ২ দলের
২৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৭:২২
।। এমএকে জিলানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকার বড় একটি অংশ নিয়ে গঠিত ঢাকা-৬ আসনে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নিজস্ব প্রার্থী নেই। আসনটিতে দুই দলই ভর করেছে শরিক দলের ওপর। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের পক্ষ থেকে এই আসনে প্রার্থী জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ।
অন্যদিকে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে এই আসনে প্রার্থী হয়েছেন গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী। আসনে আরও ছয় প্রার্থী থাকলেও এই দু’জনকেই হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে দেখছেন এলাকাবাসী।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, ওয়ারী, গেণ্ডারিয়া থানার পুরোটা এবং কোতোয়ালি ও বংশাল থানার একাংশ নিয়ে গঠিত ঢাকা-৬ আসন। এই আসনটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৪, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৪, ৪৫ ও ৪৬ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে। আসনের মোট ভোটার ২ লাখ ৬৯ হাজার ২৭৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৪৩ হাজার ৮০ জন, নারী ভোটার ১ লাখ ২৬ হাজার ১৯৬ জন।
এই আসনে নৌকা প্রতীকে কোনো প্রার্থী না থাকলেও মহাজোটের পক্ষ থেকে লাঙ্গল প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জাপা প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ। অন্যদিকে, ধানের শীষ প্রতীকে এখানকার প্রার্থী গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী। ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল হওয়ায় বিএনপি এই আসনে কোনো প্রার্থী দেয়নি। যদিও মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টি (জেপি) এই আসনে প্রার্থী দিয়েছে। বাইসাইকেল প্রতীকে দলটির প্রার্থী সৈয়দ নাজমূল হুদা। এছাড়া, কাস্তে প্রতীক নিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) আবু তাহের হোসেন, হাতপাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মনোয়ার খান, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের আহম্মেদ আলী শেখ, হারিকেন প্রতীকে বাংলাদেশ মুসলিম লীগের (বিএমএল) ববি হাজ্জাজ ও আম প্রতীকে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) আকতার হোসেন এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
শরৎগুপ্ত রোডের বাসিন্দা আহসান হাবিব (৬০) সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই আসনটি সংসদীয় নির্বাচনি ইতিহাসের একটি ঐতিহাসিক আসন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একসময় এই আসনের জনপ্রতিনিধি ছিলেন। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে এই এলাকায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অপ্রত্যাশিতভাবে বিএনপির সাদেক হোসেন খোকার কাছে পরাজিত হন। এরপর বিএনপির সাদেক হোসেন খোকা পরপর তিন বার এই আসনের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে শরৎগুপ্ত এলাকার একটি বাসায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিয়মিত আসতেন, দেশের অবস্থা নিয়ে সবার সঙ্গে বৈঠক করতেন। ইতিহাস বলছে, এই আসন নিয়ে প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দলই বেশ সচেতন ছিলেন। অথচ সামনের নির্বাচনে এই আসনে প্রধান দুইটি দলের পক্ষে নিজস্ব কোনো প্রার্থী নেই। বিষয়টি আমাদের জন্য দুঃখজনক।’
ঢাকা-৬ এর টিকাটুলি, হাটখোলা, ওয়ারী, বিসিসি রোড, স্বামীবাগ, নারিন্দা, মৈশুণ্ডী, শরৎগুপ্ত রোড, বেগমগঞ্জ, দয়াগঞ্জ, ধোলাইখাল, সূত্রাপুর, লক্ষীবাজার এলাকা সরেজিমন ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকায় ভোট উৎসবের আমেজ অনুপস্থিত। লাঙ্গল প্রতিকে কাজী ফিরোজ রশীদের ব্যানার পোস্টারই (পুরো আসনেজুড়ে নেই, কিছু কিছু জায়গায় রয়েছে) চোখে পড়ে বেশি। হাতপাখার মানোয়ার খানও ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছেন এই আসনে। ফাঁকে কিছু ব্যানার-পোস্টার রয়েছে হারিকেন প্রতিকে ববি হাজ্জাজের। বাইসাইকেল প্রতিকে জেপি প্রার্থী সৈয়দ নাজমুল হুদার কিছু ব্যানারও চোখে পড়ে। অবশ্য গত কয়েকদিনের বৈরী আবহাওয়ায় সড়ক ও গলির মাঝে ঝুলন্ত পোস্টার হারিয়ে গেছে, ঝুলছে কেবল দড়িগুলো।
টিকাটুলির মোড়ে সদ্যনির্মিত একটি বহুতল ভবনে প্রধান নির্বাচনি প্রচারকেন্দ্র গড়েছেন কাজী ফিরোজ রশীদ। রাত-দিন এই প্রচার কেন্দ্রের সামনে আনন্দ-উৎসবের চিত্র দেখা গেছে। অন্যদিকে, ধানের শীষ প্রতিকের সুব্রত চৌধুরীর নির্বাচনি প্রধান প্রচার কেন্দ্র আরামবাগে, যা নির্বাচনি এলাকার বাইরে।
সরেজিমন দেখা গেছে, এই আসনের নির্বাচনি প্রচারণায় এগিয়ে আছেন কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাচ্ছেন। ধানের শীষ প্রতিকের সুব্রত চৌধুরীও প্রচারণা চালাচ্ছেন, তবে ফিরোজ রশীদের মতো অতটা নয়। ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের হাতপাখা প্রতীকে মানোয়ার খানও প্রতিদিনই প্রচারণা চালাচ্ছেন। এর বাইরে অন্য প্রার্থীদের কোনো প্রচারণা চোখে পড়েনি।
গেণ্ডারিয়ার বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান ছোটন আসন্ন ভোট নিয়ে সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফিরোজ রশীদ ভালো মানুষ। তিনি এলাকার প্রতিটি মজজিদে সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছেন। এছাড়া পানির সমস্যা সমাধানে নতুন পাম্প স্থাপন করেছেন।’
দয়াগঞ্জের বাসিন্দা অপু সরকার বলেন, ‘যারা ভোটে খাড়াইছে, কাউরেই তো চিনি না। অহনকার এমপি সাহেবরে চিনি। কিন্তু হেরে তো একবারও দেখলাম না।’
ব্যানার-পোস্টারের উপস্থিতি আর কিছু এলাকায় প্রচারণা চললেও সার্বিকভাবে ঢাকা-৬ আসন ঘুরে দেখা গেছে, ভোট উৎসবের উত্তাপ এখনও ছড়ায়নি সেভাবে। পাশাপাশি বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক ও চাপা ক্ষোভও দেখা গেছে। স্থানীয় কয়েকজন জানালেন, বিএনপির অনেক কর্মী-সমর্থকই ভোটের মৌসুমে আওয়ামী লীগ বনে গেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ৪০ ও ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের একাধিক বাসিন্দা সারাবাংলাকে বলেন, আওয়ামী লীগ না করলে পুলিশের হয়রানি-গ্রেফতার এবং ক্ষমতাসীনদের স্থানীয় নেতাকর্মীদের হাতে পিটুনি খেতে হবে। তাই বিএনপি না করে আওয়ামী লীগ করলেই ভালো, সবদিক থেকে ভালো থাকা যাবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরও কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, মৈশুণ্ডী এলাকার কিছু তরুণ, তারা বিএনপির সমর্থক কিন্তু সক্রিয় কর্মী নন। ওই তরুণরা প্রতীক বরাদ্দের পর ফেসবুকে বিএনপি নিয়ে সেলফি পোস্ট করেছিল। এরপর তাদের পুলিশ দিয়ে শাসানো হয় এবং পরে তাদের স্থানীয় আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সমাজসেবার অংশ হিসেবে চলমান বেসরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবক হতে বাধ্য করা হয়েছে।
সারাবাংলা/জেআইএল/টিআর/এসএন