এ বছর অভিবাসন কমবে ২৭ শতাংশ: রামরু
২৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৮:৪৪
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৬ লাখ ১৪ হাজার ৫৮৫ জন বাংলাদেশি কর্মী উপসাগরীয়, অন্যান্য আরব দেশসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অভিবাসন করেছে। এই হার অব্যাহত থাকলে এই বছর অভিবাসনের হার গতবছরের তুলনায় কমবে ২৭ শতাংশ।
বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট ( রামরু) জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো ( বিএমইটি) এর তথ্য যাচাই-বাছাই করে এ হিসাব জানিয়েছে। রামরু এবং এসডিসি ২০১৮ সালে প্রকাশিত ২০টি জেলার প্যানেল ডাটা অনুযায়ী মোট অভিবাসীর ২১ ভাগ হচ্ছে ফিরে আসা অভিবাসী এবং ৭৯ ভাগ হচ্ছে বর্তমান অভিবাসী বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
রোববার ( ২৩ ডিসেম্বর) বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রামুরুর এ হিসাব জানান প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাকপ ড. তাসনিম সিদ্দিকী। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন রামরুর নির্বাহী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার শাহদীন মালিক ও প্রোগ্রাম পরিচালক মেরিনা সুলতানা।
ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে অভিবাসনকে সরকার গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন কর্মী বাংলাদেশ থেকে কাজের জন্য বিদেশে অভিবাসন করেছেন কিন্তু এ বছরে ২ লাখ ৭১ হাজার ২৩ জন কর্মীর অভিবাসন কমে যাওয়ায় এই বাজারে দুর্বলতাই প্রকাশ করে।’
বাংলাদেশে ফিরে আসা অভিবাসীদের তথ্য সংরক্ষণে কোনো প্রক্রিয়া নেই মন্তব্য করে ড. তাসমিন বলেন, ‘যার কারণে বর্তমানে মোট কতজন কর্মী বিদেশে অবস্থান করছে তা জানার কোনো উপায় নেই।’
২০১৮ সালে জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নারী অভিবাসীদের বিদেশ যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালে জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নারীকর্মী বিদেশে যাওয়ার ধারা অব্যাহত থাকে তবে এ বছরে নারী কর্মীর বিদেশ যাওয়ার হার আগের বছরের তুলনায় ২০ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ কমে আসবে। আর নারী অভিবাসীদের সংখ্যা কমে আসার সঙ্গত কারণ রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘চলতি বছরের মে মাস থেকেই নির্যাতনের কারণে নারী কর্মীরা দেশে ফেরত আসতে থাকেন। গণমাধ্যমে সেই চিত্র দেখার পরে অনেক নারী কর্মী বিদেশে যেতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। তাছাড়া প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং বিএমইটি নারীকর্মীদের ব্যাপারে সতর্কতা বাড়িয়ে দেয়, ফলে নারী কর্মীর বিদেশ যাওয়ার হার এ বছর হ্রাস পেয়েছে। এই দুটো কারণের পাশাপাশি সার্বিকভাবে নারী ও পুরুষকর্মীর বিদেশ যাওয়ার হার গত বছরের তুলনায় এ বছর কমেছে।’
আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহার অভিবাসীদের বিষয়টি তুলে ধরে তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দল এবং জোট গুলো নিজস্ব ইশতেহার ঘোষণা করেছে। আওয়ামী লীগের দেওয়া ইশতেহারে শ্রমিক কল্যাণ ও শ্রমনীতির অধীনে অভিবাসীদের বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশে আরো বেশি সংখ্যক সংখ্যক প্রশিক্ষিত কর্মী প্রেরণ এবং তাদের শ্রমলব্ধ অর্থের আয়বর্ধক এবং লাভজনক বিনিয়োগ নিশ্চিতকরণ সম্পর্কিত নীতি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখা হবে বলে উল্লেখ করা হয়। বিদেশ যাওয়ার সময় প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক হতে নমনীয় শর্তে সুদ এবং দেশে ফেরার পর স্থায়ী কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ প্রদান সুনিশ্চিত করা হবে। আবার ঐক্যজোটের ৩৫ টি লক্ষ্যের মধ্যে ২৩ তম লক্ষ্য হচ্ছে প্রবাসী কল্যাণ। এই জোট ক্ষমতায় এলে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করবে বলে অঙ্গীকার করেছে। প্রশিক্ষণ, অভিযোগ নিষ্পত্তি, বিমানবন্দরে বিশেষ সুবিধা, বিনিয়োগ প্রণোদনা, অভিবাসীর মরদেহ বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া এবং বিদেশে অবস্থানরত দীর্ঘমেয়াদি দক্ষ পেশাজীবীদের দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার সুযোগ তৈরি করা তাদের মধ্যে অন্যতম। ঐক্যজোটের পাশাপাশি বিএনপির নিজস্ব ১৮ দফা ইশতেহারও প্রবাসীদের ভোটাধিকার বিষয়টি স্থান পেয়েছে।’
এ ছাড়া রামরুর প্রতিবেদনের স্থান পাওয়া বিষয় গুলোর মধ্যে রয়েছে, নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে নারীকর্মীদের সৌদি আরব থেকে অপ্রত্যাশিত প্রত্যাবর্তন, প্রবাসীদের জন্য ১২ ধরনের চাকরি বন্ধ ঘোষণা সৌদি আরবের, মালয়েশিয়ার সরকার পরিবর্তন সিন্ডিকেট ব্যবস্থা বাতিল, সংযুক্ত আরব আমিরাতে পুরুষ অভিবাসন বন্ধ, বাংলাদেশ আইন পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড আইন পাস উল্লেখযোগ্য।
এ ছাড়া সংবাদ সম্মেলনে রামরুর পক্ষ থেকে ছয় দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে অভিবাসীদের শুধু লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে, এসডিজি সুফলভোগে অভিবাসী ও তার পরিবারকে অংশীদার করতে হবে, বিপদে পড়া বা নিগৃহীত নারী শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য অভিবাসনের দেশে সরকারের বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। যেমন আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা, আইনজ্ঞ ও দোভাষী নিয়োগের ব্যবস্থা এবং মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নারী অভিবাসী সেই দেশে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বিদ্যমান সেফ হোমগুলোর মানোন্নয়ন এবং সংখ্যা বৃদ্ধি। অভিবাসন প্রক্রিয়াকরণে মাঠ পর্যায়ে অভিবাসীদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রদান করতে হয়। অভিজ্ঞ সেবাদানকারীর ছাড়া সেই কাজগুলো বর্তমান ব্যবস্থায় সম্পাদন সম্ভব নয়। এই সেবার শূন্যতা পূরণ করছে মাঠ পর্যায়ের দালালরা। যে কাজগুলো তারা সম্পাদনা করে, সেগুলো প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য দালালের ভূমিকাকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করা এবং ২০১৩ সালের অভিবাসন আইনে তার প্রতিফলন ঘটানো এখন সময়ের দাবি। ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার ফান্ড এর অর্থ প্রশাসনিক এবং কাঠামো নির্মাণের বা পরিচালনার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করে। শুধুমাত্র অভিবাসীদের প্রত্যক্ষ সেবা দান এই অর্থ ব্যবহার নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি। অন্যথায় অভিবাসীদের এই চাঁদার পরিমাণ কমিয়ে ফেলা প্রয়োজন।অভিবাসী প্রদেয় চাঁদা থেকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ৯৫ ভাগ মূলধন সংগৃহীত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এই ব্যাংকের পারফরমেন্স মূল্যায়ন করে এর বাস্তব কার্যকারিতা সম্পর্কে অভিবাসীদের অবহিত করা, কফিল যে কাজের জন্য বিদেশে নিয়েছে, তার সঙ্গে কাজ না করে কাজ খুঁজে নিয়ে কাজ করার যে পদ্ধতি ফ্রি ভিসা বলে পরিচিত, তার বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রয়োজন।
রামরুর নির্বাহী কমিটির সদস্য ও আইনজীবী ব্যারিস্টার শাহদীন মালিক বলেন, ‘নারী অভিবাসীদের নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি পত্রিকায় দেখেছি। কিন্তু এটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া খুব কঠিন কাজ হবে। এর কারণ মূলত সৌদি আরবের মতো দেশে নারীকে মানুষ মনে করে না। নারীকে প্রধানত একটি ভোগের পণ্য হিসেবে দেখা হয়।’
‘যেহেতু নারীকে ভোগের পণ্য হিসেবে দেখা হয়, সেহেতু নারীরা গিয়ে মানুষের মতো ব্যবহার প্রত্যাশা করবে সেটা একটা গোড়াতেই গলদের মতো ব্যাপার হবে। সৌদি আরবের মতো দেশে নারীদের যাওয়া আমার কাছে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়’ বলেন শাহদীন মালিক।
সারাবাংলা/জেএ/একে