হোটেল-রেস্টুরেন্টে ময়লা পানি, রাজশাহীতে বাড়ছে পানিবাহিত রোগ
২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ১১:৫৪
।। সুমন মুহাম্মদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট ।।
রাজশাহী: প্রতিদিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজসহ জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এসব রোগীর অধিকাংশই যারা মহানগরীতে দীর্ঘদিন রয়েছেন বা কাজের সন্ধানে এখানে এসেছেন। মূলত নগরীতে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা পানি পান করেই অসুস্থ হয়েছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাওয়ার জন্য যে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে থালা-বাসন, কাপড়সহ অন্যান্য সামগ্রী ধোয়ার উপযোগি, তাই বাড়ছে অসুস্থতা।
স্থানীয়রা বলছেন, পানি সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত অধিকাংশ পাইপলাইনই রয়েছে ড্রেনের মধ্যে। কিন্ত নিয়মিত পরিস্কার ও সংস্কার না করায় কোনো কোনো স্থানে ছিদ্র হয়ে ঢুকছে ময়লা-আবর্জনা। আর হোটেল-রেস্টুরেন্টে সেই পাইপলাইন দিয়েই সরবরাহ করা হচ্ছে পানি। এছাড়া বর্তমানে ৪টি পানি শোধনাগারই বিকল হয়ে থাকায় পাম্পে তোলা অস্বাস্থ্যকর পানি পান করছেন মহানগরবাসী। পুরো রাজশাহী মহানগরী জুড়েই এই অবস্থা বিরাজ করছে।
জানা গেছে, রাজশাহী মহানগরীতে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ১৯৩৭ সালে চালু হয়। পৌরসভা ও পরবর্তীতে সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠা হলে পানি সরবরাহ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা হয় এবং চাহিদামত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য বাস্তবায়ন করা হয় বিভিন্ন প্রকল্প। এসবের মাধ্যমে চাহিদার ৬৫ ভাগ পানি সরবরাহ সম্ভব হয়। তবে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে গভীর নলকূপ স্থাপনের পাশাপাশি রাজশাহী সিটি করপোরেশন বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহে ২০০৪ সালে ৩টি ও ২০০৭ সালে ১টি (ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) পানি শোধনাগার চালু করে। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করায় এর সুবিধা খুব বেশিদিন ভোগ করতে পারেননি মহানগরবাসী। বর্তমানে ৪টি পানি শোধনাগারই বিকল হয়ে রয়েছে।
তবে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য ২০১১ সালে সিটি করপোরেশনের পানি বিভাগকে সম্পূর্ণ আলাদা করে প্রতিষ্ঠা করা হয় রাজশাহী ওয়াসা। কিন্ত ওয়াসা কর্তৃপক্ষও গত ৭ বছরে মহানগরীর চাহিদার শতভাগ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ পারিবারিক কাজে ময়লা-আবর্জনা মিশ্রিত পানিই একমাত্র ভরসা হয়ে উঠছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মহানগরীতে হোটেল-রেস্টুরেন্ট রয়েছে ৮৩টি। এর সবগুলোতেই খাবার জন্য পানি দেওয়া হয় পাইপলাইনে। সাধারণত এই পানি হাত-মুখ, কিংবা থালা বাসন ধোয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়, কিন্ত হোটেলগুলোতে নিজস্ব টিউবয়েলের ব্যবস্থা না থাকায় সেই পানিই দেওয়া হচ্ছে খাবার জন্য। আবার বেশিরভাগ হোটেলেই ফিল্টার করা (মিনারেল ওয়াটার) পানি পাওয়ারও সুযোগ নেই। মহানগরীর রেলগেট, বিন্দুর মোড়, দড়িখড়বোনার মোড়, বর্ণালী মোড়, রেলস্টেশন, সাহেব বাজার, লক্ষিপুর, কোটচত্বরসহ মহানগরীর সব এলাকার হোটেলগুলোতেই দেখা যায় ট্যাপের পানি বালতি বা বড় ড্রামে ভরে রাখা হয়। ওই পানি দিয়ে হোটেলের যাবতীয় কাজের পাশাপাশি মানুষকে পান করতে দেওয়া হয়।
কোট হড়গ্রাম এলাকার হোটেল মালিক সমশের বলেন, ‘দিনে প্রায় হাজার লোক খেতে আসে। এতো লোকের জন্য টিউবওয়েল থেকে পানি নিয়ে আসা সম্ভব হয় না। আগে প্রতিদিন পানি আনার জন্য একজন শ্রমিক থাকতো, কিন্ত আশপাশে টিউবওয়েল নষ্ট হবার কারণে তাও হচ্ছে না। এখন পানি আনতে হলে ভ্যানে করে ড্রামে নিয়ে আসতে হবে। কিন্ত সেটাও সম্ভব হয়না। তারপরও ক্রেতাদের সাধ্যমত পরিস্কার পানি পান করানোর চেষ্টা করি।’
মহানগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকার নাইমুর রহমান নামের এক কলেজছাত্র অভিযোগ করে বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে কোচিংয়ে যাওয়ার সময় বিন্দু হোটেলে খাই। কিন্তু একদিনও ভাল পানি পাই না।’
মহানগরীর গণকপাড়া এলাকার হোটেল মালিক রেজাউল জানান, প্রতিদিন বিকাল থেকে রাত ২টা পর্যন্ত হোটেল খোলা থাকে। যার কারণে ড্রামে পানি লোড করে রাখতে হয়। আর ওয়াসা ঠিকমত লাইন পরিস্কার করে না। তাই আয়রন ও অনেক ময়লা বের হয়।
রাজশাহী ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পারভেজ মাহমুদ জানান, মহানগরীতে দৈনিক ১ কোটি ৩৫ লাখ লিটার চাহিদার বিপরীতে ৬১০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে ৪০ হাজার আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প গ্রাহকের ৭২ লাখ লিটার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। মহানগরীতে নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর পানি সরবরাহ এবং সুয়ারেজের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ওয়াসা ২০৩৫ সাল পর্যন্ত পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনার মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন শুরু করেছে। এখন মহানগরীর ৩০ ওয়ার্ডের ১০৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় একটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ও ৯০টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে ৯ লাখ নগরবাসীকে পানি সরবরাহ করা হয়। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ওয়াসার পানি পান নগরবাসী।
তিনি জানান, পাইপলাইনে সরবরাহকৃত পানিতে ময়লা আবর্জনা রয়েছে। তবে পরিস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এরইমধ্যে ৪৫০টি স্থান চিহ্নিত করে তার পরিস্কার করা হয়েছে। মূলত পাম্পের মাধ্যমে উত্তোলন করা ভূগর্ভস্থ পানিতে অতিরিক্ত আয়রন থাকায় পাইপ লাইনে ময়লা জমছে। তবে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার ফরাদপুরে একটি পানি শোধনাগার স্থাপন করার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদও হয় এবং সেই প্রকল্পের কাজও শুরু হয়েছে। পদ্মা নদীর পানি পাইপের মাধ্যমে এনে তা শোধন করে পুরো মহানগরীতে সরবরাহ করা হবে। তখন মহানগরবাসী বিশুদ্ধ পানি পাবে এবং পানির সঙ্কট থাকবে না বলে জানান ওয়াসার এই শীর্ষ কর্মকর্তা।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. খলিলুর রহমান জানান, বর্তমানে মেডিসিন বিভাগে যেসব রোগি ভর্তি হয় তাদের বেশিরভাগই পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত। বর্হিবিভাগে প্রতিদিন কমপক্ষে শতাধিক রোগি এই ধরনের মিলে। তাই পাইপলাইনে সরবরাহকৃত পানি ফুটিয়ে খেলে এবং একটু সচেতন হলেই এসব রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
সারাবাংলা/এমও