জামায়াত অধ্যুষিত চট্টগ্রামের ৩ আসনে ‘সহিংসতার ঝুঁকি’
২৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ১১:৩২
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: সহিংস রাজনীতিতে জড়িত জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত চট্টগ্রামের তিনটি আসনে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে নিয়ে আশঙ্কা আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে। আসনগুলো হচ্ছে- সাতকানিয়া-লোহাগাড়া, বাঁশখালী এবং সীতাকুণ্ড। তবে সহিংসতা মোকাবিলায় পূর্ণ প্রস্তুতি আছে জানিয়ে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা বলেছেন, ‘ভোটের দিন কেউ উল্টাপাল্টা করলে ডাইরেক্ট অ্যাকশন হবে।’
জেলার বাইরে চট্টগ্রাম মহানগরীতেও জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত এলাকার কেন্দ্রগুলোতে ঝুঁকি তৈরির কথা বিবেচনায় নিয়ে ভোটের দিনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে প্রশাসন।
পুলিশ সূত্রমতে, চট্টগ্রাম জেলায় ভোটকেন্দ্র আছে ১৩০২টি। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ (পুলিশের ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ) হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ৮৩২টি। ৩৯১টি কেন্দ্রকে সাধারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া দ্বীপাঞ্চলের ৭৯টি কেন্দ্রকে বিশেষ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১২ সাল থেকে ২০১৪, ২০১৫ সাল পর্যন্ত সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া, বাঁশখালী এবং সীতাকুণ্ড উপজেলায় যে ধরনের নাশকতা হয়েছিল, গাছ কেটে সড়কে রেখে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, গাড়িতে আগুন দেওয়া, বোমা মারা এই ধরনের স্যাবোটাজ তো একই এলাকায় আবার হতেও পারে। কারণ সাতকানিয়া-লোহাগাড়া ও বাঁশখালীতে জামায়াতের প্রার্থী আছে। তারা দেশের বিভিন্নস্থান থেকে তাদের ক্যাডারদের সেখানে এনে জড়ো করতে পারে।’
সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একবার শুনেছিলাম ২১ তারিখ তারা (জামায়াত-শিবির) নামবে। এরপর শুনেছি ২৪ তারিখ নামবে। ২৭ তারিখ চলে এল, তবুও তো নামল না। ভোটের দিন হয়ত স্যাবোটাজ করতে পারে। তবে টেনশনের কিছু নেই। আমরা প্রস্তুত আছি। উল্টাপাল্টা কিছু করতে চাইলে ডাইরেক্ট অ্যাকশন। এক্ষেত্রে আমাদের টলারেন্সের পরিমাণ থাকবে জিরো।’
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলা মিলে চট্টগ্রাম-১৫ আসন। এই আসনে ভোটকেন্দ্র আছে ১৪৭টি। এর মধ্যে সাতকানিয়া থানা এলাকায় ৮৮টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ৬৬টি ও সাধারণ ২২টি কেন্দ্র আছে। লোহাগাড়া থানায় ৫৯টি কেন্দ্রের মধ্যে সবগুলোকেই ঝুঁকিপূর্ণ বা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে পুলিশ।
জামায়াত-শিবিরের মুক্তাঞ্চল হিসেবে পরিচিত সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় একাধিকবার জামায়াত ইসলামী থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এবার সেখানে ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী হয়েছেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য আ ন ম শামসুল ইসলাম।
বাঁশখালী উপজেলা নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-১৬ আসনে মোট ভোটকেন্দ্র আছে ১১০টি। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ৭৮টি ও সাধারণ ৩২টি কেন্দ্র আছে। এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জামায়াতের এক নেতা লড়ছেন।
সীতাকুণ্ড এবং চট্টগ্রাম মহানগরের একাংশ নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-৪ আসনে ভোটকেন্দ্র আছে ৮০টি। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ৬৩টি ও সাধারণ ১৭টি কেন্দ্র আছে। এই আসনে জামায়াতের কোন প্রার্থী নেই। তবে ধানের শীষের প্রার্থী ইসহাক কাদের চৌধুরীর ভাই বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী সহিংস রাজনীতির নেতৃত্বদাতা হিসেবে সমালোচিত। তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন।
এই চারটি উপজেলার মধ্যে সীতাকুণ্ড দেশের অর্থনীতির ‘লাইফ লাইন’ খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত। সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় ঘোষণার পর এবং ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকাতে সহিংস আন্দোলনের প্রভাবে এই মহাসড়কগুলোতে যানবাহন ও সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর এবং ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে বাঁশখালী পৌরসভাসহ বিভিন্ন গ্রামকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা।
তিনটি আসনে নিরাপত্তার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এসপি নুরে আলম মিনা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের ৩টি এপিসি (সাজোয়া যান) রেডি থাকবে। এক্সট্রা ফোর্স থাকবে। অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি রেডি থাকবে। অগ্নি নির্বাপক উপকরণ থাকবে।’
চট্টগ্রাম জেলার বাকি থানাগুলোর মধ্যে মিরসরাই থানায় ৩৪টি গুরুত্বপূর্ণ ও ১৫টি সাধারণ, জোরারগঞ্জ থানায় ৫২টি গুরুত্বপূর্ণ ও ৩টি সাধারণ, ফটিকছড়ি থানায় ৭৮টি গুরুত্বপূর্ণ ও ৯টি সাধারণ, ভুজপুর থানায় ৪৪টি গুরুত্বপূর্ণ ও ৫টি সাধারণ, সন্দ্বীপ থানায় ২৯টি গুরুত্বপূর্ণ ও ৫০টি সাধারণ, হাটহাজারী থানায় ৭৩টি গুরুত্বপূর্ণ ও ৩৩টি সাধারণ, রাউজান থানায় ২১টি গুরুত্বপূর্ণ ও ৬৩টি সাধারণ, রাঙ্গুনিয়া থানায় ৬০টি গুরুত্বপূর্ণ ও ২৮টি সাধারণ, বোয়ালখালী থানায় ৪১টি গুরুত্বপূর্ণ ও ৩৬টি সাধারণ, পটিয়া থানায় ৪২টি গুরুত্বপূর্ণ ও ৬৯টি সাধারণ, আনোয়ারা থানায় ৩০টি গুরুত্বপূর্ণ ও ৩৪টি সাধারণ, চন্দনাইশ থানায় ৫৮টি গুরুত্বপূর্ণ ও ১০টি সাধারণ এবং আসন হিসেবে চন্দনাইশের সঙ্গে সংযুক্ত সাতকানিয়া উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ৩৬টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ২৬টিকে গুরুত্বপূর্ণ ও ১০টিকে সাধারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ।
এদিকে চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৫৯৭টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ২০০টি কেন্দ্রকে গুরুত্বপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে সিএমপি। আর ৩৯৭ কেন্দ্রকে সাধারণ হিসেবে বিবেচনা করছে।
নগরীর কোতোয়ালী থানায় ২৬টি গুরুত্বপূর্ণ ও ৪৫টি সাধারণ ভোটকেন্দ্র, চকবাজার থানায় ৭টি গুরুত্বপূর্ণ ও ১৩টি সাধারণ কেন্দ্র, বাকলিয়া এলাকায় ১১টি গুরুত্বপূর্ণ ও ২৮টি সাধারণ, সদরঘাট থানার ৯টি গুরুত্বপূর্ণ ও ১৬টি সাধারণ কেন্দ্র, চান্দগাঁও থানায় ২৫টি গুরুত্বপূর্ণ ও ৩৬টি সাধারণ কেন্দ্র, পাঁচলাইশ থানায় ২৪টি সাধারণ ও ৯টি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, বায়েজিদ বোস্তামী থানায় ১২টি গুরুত্বপূর্ণ ও ৩৭টি সাধারণ কেন্দ্র, খুলশী থানায় ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ ও ২৪টি সাধারণ, ডবলমুরিং থানায় ১৪টি গুরুত্বপূর্ণ ও ৩১টি সাধারণ কেন্দ্র, হালিশহর থানায় ১০টি গুরুত্বপূর্ণ ও ২০টি সাধারণ কেন্দ্র, পাহাড়তলী থানায় ১১টি গুরুত্বপূর্ণ ও ১৫টি সাধারণ, আকবর শাহ থানায় পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ও ১৩টি সাধারণ কেন্দ্র, বন্দর থানায় ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ ও ২৮টি সাধারণ, ইপিজেড থানায় ১২টি গুরুত্বপূর্ণ ও ২২টি সাধারণ কেন্দ্র, পতেঙ্গা থানায় ৫টি গুরুত্বপূর্ণ ও ১৯টি সাধারণ কেন্দ্র এবং কর্ণফুলী থানায় ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ ও ২৬টি সাধারণ ভোটকেন্দ্র আছে।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ ও সাধারণ ভোটকেন্দ্রে শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণের সব প্রস্তুতি আমরা সম্পন্ন করেছি। প্রত্যেক কেন্দ্রে আনসারসহ মিলে অন্ত:ত ১১ জন ফোর্স থাকবে। কিছু কেন্দ্রে আরও বেশি থাকবে।
শুক্রবার (২৮ ডিসেম্বর) থেকে নগরীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ নির্বাচনের দায়িত্ব শুরু করবে জানিয়ে আমেনা বেগম বলেন, শনিবার থেকে পুলিশ সদস্যরা কেন্দ্রে কেন্দ্রে চলে যাবেন। এর আগে আমরা নগরীতে বিভিন্ন স্পটে তাদের মোতায়েন করছি।
চট্টগ্রাম জেলায় প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে পাঁচস্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) মহিউদ্দিন মাহমুদ সোহেল।
তিনি জানান, পাঁচস্তরের মধ্যে প্রথম স্তরে একজন এএসআই, ২ জন কনস্টেবল ও ১০ জন আনসার, গ্রাম পুলিশ থাকবে। দ্বিতীয় স্তরে একজন উপ-পরিদর্শকের (এসআই) নেতৃত্বে মোবাইল টিম থাকবে প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভা ভিত্তিক। তৃতীয় স্তরে থাকবে পরিদর্শক, সহকারী পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের সমন্বয়ে গঠিত স্ট্রাইকিং রিজার্ভ টিম ও তদারকি টিম। চতুর্থ স্তরে বিজিবি ও কোস্টগার্ড এবং পঞ্চম স্তরে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী টহলের দায়িত্বে থাকবে।
চট্টগ্রামের ১৩টি আসনে ২০০টি মোবাইল টিমসহ সাড়ে ৩ হাজার পুলিশ সদস্য নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবেন বলেও তিনি জানান।
ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে আসা ও ফিরে যাওয়া, কেন্দ্র দখল এবং ব্যালট পেপার ছিনতাই প্রতিরোধকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন মাহমুদ সোহেল।
মহানগরী ও জেলা মিলিয়ে চট্টগ্রামে মোট আসন সংখ্যা ১৬টি।
সারাবাংলা/আরডি/এমএইচ