নির্বাচন পরবর্তী অর্থনৈতিক ভাবনা
৮ জানুয়ারি ২০১৯ ০৭:৪০
।। সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।।
অর্থবছরের আরও পাক্কা ছয় মাস আছে। এর মধ্যে নতুন সরকার। যদিও নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন মন্ত্রিসভায় আগের সরকারের ধারবাহিকতাই রয়ে গেছে। সুতরাং অনেক কিছুতেই ধারাবাহিকতা থাকবে।
গত ১০ বছরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় উন্নয়ন। এই উন্নয়ন বলতে প্রথমেই আলোচিত পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, মাতারবাড়ি তাপভিত্তিক কয়লা প্রকল্প, রামপাল প্রকল্প, মেট্রোরেলসহ নানা অবকাঠামো বাস্তবায়নের কথা। এই সময়ে জিডিপি বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, বাংলাদেশ স্বল্পন্নোত দেশ থকে উন্নয়নশীল দেশে পা রেখেছে। সামাজিক খাতে ব্যাপক অগ্রগতিও বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত।
কিন্তু এ কথাও তো সত্য যে দেশের মানুষ কতটা ভালো থাকবেন, তা জিডিপি’র ওপর নির্ভর করে না। এত এত প্রবৃদ্ধি হলেও অসংখ্য মানুষ এখনও নিরক্ষর আছে, থাকার মতো বাড়ি নেই তাদের, পানির ব্যবস্থা নেই, শৌচাগার নেই, কাজ নেই, আয় নেই। মাথাপিছু আয় যেমন আলোচনায়, তেমনি বহু উচ্চারিত শব্দ বৈষম্য।
ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৯-এ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের ওপরেই থাকবে। বাংলাদেশ ২০৭টি দেশে নানা পণ্য রফতানি করে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আয় করেছে প্রায় ৩৭ বিলিয়ন ডলার। আর এসবই সম্ভব হচ্ছে দেশের কর্মক্ষম মানুষের সৃজনশীলতায়। জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের গড় বয়স ৩০-এর নিচে। বাংলাদশে শিক্ষিত বেকারের হার ৪৭ শতাংশ। এর অর্থ হলো মানবসম্পদের একটা বড় অংশই কাজের বাইরে থাকছে। প্রতিবছর ২০ লাখের বেশি মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে বেকার সমস্যাকে চলমান রাখছে।
ছয় মাস পর যে বাজেট আসবে, তাতে সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ এই বিপুলসংখ্যক তরুণের জন্য কাজের ব্যবস্থা কী হবে, সেই আয়োজনের নির্দেশনা দেওয়া। নতুন অর্থবছরের আরেক আশঙ্কা খাদ্য বহির্ভূত জিনিসের দাম। এসবের দাম বাড়তি আছে অনেকদিন ধরে। আমদানিকৃত গ্যাসের চড়া দাম, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়া আর স্থানীয় মুদ্রার বিনিময়মূল্য কমে যাওয়ার ফলে সেবা ও পরিবহন খাতে দাম বাড়বে, যা এ বছর মুদ্রাস্ফীতিকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। বিগত ১০টি বছরে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম তলানিতে গিয়ে ঠেকলেও বাংলাদেশের মানুষ সেই সুবিধা পায়নি। ২০১৭ সালে বন্যার কারণে বড় অঙ্ক ব্যয় হয়েছে খাদ্য আমদানিতে, যার প্রভাব পড়েছে আমদানি-রফতানির বাণিজ্য ভারসাম্যে। সেপ্টেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় ছিল ৩১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, যা প্রায় ৮ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান।
একটি দেশের সমৃদ্ধি নির্ভর করে তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর, রাজস্ব বাড়ানোর ক্ষমতার ওপর। রাজস্ব কী ভাবে বণ্টন হবে, সেটাও জরুরি প্রশ্ন। ভ্যাট নামের পরোক্ষ করের ওপর ব্যাপক নির্ভরতা সাধারণ মানুষের জন্য নিবর্তনমূলক। বহুবার চেষ্টা করেও এই ব্যবস্থার আধুনিকায়নের লক্ষ্যে নতুন ভ্যাট আইন চালু করা যায়নি ব্যবসায়ী সমাজের চাপে। দেখার বিষয়, এই ছয় মাসে সরকার কতটা শক্তি পায় আগামী অর্থবছর থেকে তা কার্যকর করার জন্য।
বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় সমস্যা ছিল অবকাঠামোর অভাব। গাড়ি চলার মতো রাস্তা নেই, যথেষ্ট বিদ্যুৎ নেই। শুধু এই দু’টির ব্যবস্থা করা গেলে কোনো বাড়তি সরকারি সাহায্য বা উদ্যোগ ছাড়াই অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসা সম্ভব। শেখ হাসিনা ১০টি বছরে সেটিতে সাফল্য পেয়েছেন। কিন্তু তবুও অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ মাইগ্রেশন কমানো যাচ্ছে না। গ্রাম থেকে মানুষ কাজের সুযোগের সন্ধানে শহরে আসছে। এই সমস্যা সামাল দেওয়ার একটাই উপায়— গ্রামকেই উন্নত করা। আশার কথা, আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনে ইশতেহারে ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ দর্শনের কথা বলেছে।
১০ বছরে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি, টাকা পাচার এবং কেলেঙ্কারির পর পুঁজিবাজারে ধস নামা। ব্যাংকিং ব্যবস্থার চেহারা ফিরিয়ে আনতে হলে সংস্কারের দিকে হাঁটতে হবে। প্রথম কাজ হবে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা বিচার করে যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শুরু করা। দ্বিতীয় কাজ হবে গতানুগতিক ধারায় এসব ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগ বন্ধ করা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা প্রয়োগ করার সুযোগ তৈরি করতে সরকারের উচিত হবে যত দ্রুতসম্ভব অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত শাখা বিলুপ্ত করা। এর মাধ্যমেই নগ্নভাবে আর্থিক খাতে আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হচ্ছে এবং হলমার্ক বা বেসিক ব্যাংকের মতো বড় কেলেঙ্কারি ঘটেছে। ব্যাংক খাতে কোনো মালিক থাকতে পারে না, কারণ জনগণের টাকা এখানে রক্ষিত থাকে। কিছু ঋণখেলাপি উদ্যোক্তা নিজেদের মালিক পরিচয় দিয়ে জনগণের টাকা নিজেদের করে নিতে প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের পরিবারে ব্যাংকগুলোকে কুক্ষিগত করতে সফল হয়েছে। সরকার এখন একটু জনগণের কথা ভাবুক। এদের দুয়েকজন সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। সরকারের কাছে প্রত্যাশা, এরা যেন আর কোনো বাড়তি সুবিধা আদায় করে নিতে না পারে। এরা যেন বড় কোনো নীতি নির্ধারণী পদ-পদবি না পায়।
অবকাঠামো খাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ বেশি প্রত্যাশিত। নতুন বছরে সেই কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ গতি ফিরিয়ে আনার দিকে সরকার দৃষ্টি দেবে বলেই আশা করা যায়। সরকারের গত দুই মেয়াদে সবচেয়ে বেশি পেয়েছে আমলাতন্ত্র। প্রধানমন্ত্রী উদার হস্তে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন ও সুযোগ সুবিধা বাড়িয়েছেন। আশা করছি এবার জনগণের জন্য দৃষ্টিগ্রাহ্য কিছু দেখা যাবে।
লেখক: এডিটর ইন চিফ, সারাবাংলা ডটনেট, দৈনিক সারাবাংলা ও জিটিভি
সারবাংলা/এসআইআর/এমএম