পদ্মার তলদেশের কাদামাটি রূপ নিচ্ছে শক্ত-স্থায়ী কাঠামোয়
৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০৮:২৮
।। এমএকে জিলানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
মাওয়া-জাজিরা থেকে ফিরে: প্রমত্তা পদ্মার তলদেশের কাদামাটির স্তর এতই জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ যে, শুরুতে পদ্মাসেতুর ৪২টি খুঁটির মধ্যে ১১টির পাইলিং (গাঁথুনি) স্থাপন করা যাচ্ছিল না। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আমেরিকা, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রযুক্তির সমন্বয়ে ওই খুঁটিগুলোর নিচের কাদামাটি বশে এনেছেন প্রকৌশলীরা। এখন সেই মাটি শক্ত ও স্থায়ী কাঠামোতে রূপান্তরিত হচ্ছে।
মাটি জমাট বাঁধাসহ বড় বড় ঢেউ মোকাবিলায় উপকূলীয় অঞ্চলে গাছের শেকড় যেভাবে কাজ করে, ওই ১১টি খুঁটির পাইলিংয়েও এই ধরনের বিশেষ প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়েছেন দেশ-বিদেশের প্রকৌশলীরা। ইতোমধ্যে ৯টি খুঁটির পাইলিং নকশা শেষ হয়েছে। বাকি ২টির নকশা ১৪ জানুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত হওয়ার কথা।
আরও পড়ুন: পাখির চোখে দেখে আসা পদ্মাসেতু
কাদামাটির জটিলতা বিষয়ে পদ্মাসেতুর উপ-প্রকৌশলী (সেতু) দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের বলেন, ‘‘সাধারণত পদ্মা নদীর পানির নিচে গড়ে ৬ মিটার গভীর থেকে মাটির স্তর (রিভার বেড লেয়ার) শুরু হয়েছে। এই মাটির স্তর ১১৩ মিটার পর্যন্ত। ১১৩ মিটার থেকে শুরু হয়েছে কাদামাটির স্তর, যা খুবই জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ। এই কাদামাটির স্তরে ‘মাইকা’র (এক ধরনের মিহি দানাদার মাটি)পরিমাণ বেশি থাকায় শুরুতে পদ্মাসেতুর ১১টি খুঁটির পাইলিং করা যাচ্ছিল না।’’
‘মাইকা’ সম্পর্কে ‘জার্নাল অব দ্য সাউথ আফ্রিকান ইনস্টিটিউট অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং’ থেকে প্রকাশিত ‘ইনফ্লুয়েন্স অব মাইকা অন আনকনফাইনড কমপ্রেসিভ স্ট্রেনথ অব এ সিমেন্ট-ট্রিটেড ওয়েদারথ গ্রানাইট গ্রাভেল’ শীর্ষক প্রবন্ধে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার মাইকেল এমএস হালি বলেন, ‘সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে প্রকৌশলীদের প্রাকৃতিক অনেক বাধার মুখে পড়তে হয়। যার মধ্যে নুড়ি পাথরের স্তর একটি সাধারণ বাধা। কিন্তু অনেক সময়েই প্রকৌশলীদের মাইকার বাধার সম্মুখীন হতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘মাইকা পানির নিচে কাদামাটির এমন একটি স্তর, যাকে কিছুতেই বাগে আনা যায় না। সেতু নির্মাণের জন্য যে পাইলিং করা হয়, ওই পাইলিংয়ে মাইকাকে জমাট বাঁধানো সম্ভব হয় না। তাই বিকল্প পন্থা বের করতে হয়।’
এই প্রসঙ্গে দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের বলেন, ‘পদ্মার তলদেশে ১১৩ মিটার থেকে ১৫০ মিটার পর্যন্ত অনুসন্ধান করেও কাদামাটির স্তরের শেষ দেখা না পাওয়ায় নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। এতে ১১টি খুঁটির নিচের পাইলিংয়ের গভীরতা গড়ে ১০৪ মিটার করা হচ্ছে। প্রথমে একেকটি খুঁটির নিচে ৬টি করে পাইলিং করার কথা থাকলেও পরিবর্তিত নকশা অনুযায়ী, ১১টি খুঁটির প্রতিটির নিচে ৭টি করে পাইলিং হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘১১টির মধ্যে ৯টি খুঁটির নিচের পাইলিং নকশা চূড়ান্ত হয়েছে। আগামী ১৪ জানুয়ারি বাকি ২টি খুঁটির নিচের পাইলিংয়ের নকশা চূড়ান্ত হবে।’
পদ্মাসেতুর উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘যমুনা নদীতে ৮০ মিটার গভীর থেকেই পাথরের স্তর শুরু হয়েছে। কিন্তু পদ্মা নদীর ধরন ভিন্ন। বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি অনুযায়ী, দেশের দক্ষিণাঞ্চল বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি অবস্থিত। তাই পদ্মাসহ দক্ষিণাঞ্চলেরর নদ-নদীতে মাইকার পরিমাণ বেশি। অন্যদিকে, দেশের উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীতে পাথরের স্তর বেশি।’
পদ্মাসেতু নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, খাঁজকাটা ধরনের বিশেষ টেকনোলজির আদলে গড়া হচ্ছে ওই ১১টি খুঁটির নিচের পাইলিং। যেখানে লম্বায় ১২০ থেকে ১৩০ মিটার আর ১০ ফুট ব্যাসের লোহার বিশেষ খাঁজকাটা কাঠামোর মধ্য দিয়ে সিমেন্ট ও কংক্রিটের মিশ্রণ পদ্মার তলদেশে পাঠানো হচ্ছে। এই মিশ্রণ পদ্মার কাদামাটির সঙ্গে যুদ্ধ করে শক্ত-স্থায়ী কাঠামোতে পরিণত নিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের বলেন, ‘এই খুঁটিগুলোর পাইলিং করতে এমন প্রযুক্তি ও জ্ঞানের ব্যবহার করা হচ্ছে, যা একেবারেই নতুন কিন্তু কার্যকর ফর্মুলা। প্রকৌশল বিদ্যায় এই প্রযুক্তি ও জ্ঞানকে বলা হয় টিউব অ্যা ম্যানশেট (ট্যাম) টেকনোলজি।’
আরও পড়ুন: যত বিস্ময়-বৈচিত্র্য পদ্মাসেতুর!
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মূল সেতু নির্মাণের পাশাপাশি নদীশাসন, মাওয়া অ্যাপ্রোচ রোড, জাজিরা অ্যাপ্রোচ রোড ও সার্ভিস এরিয়া—এই পাঁচ ভাগে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলছে।
সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মূল সেতু নির্মাণের কাজ ৭২ শতাংশ আর পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৬২ শতাংশ। নদীশাসনের কাজ হয়েছে ৪৮ শতাংশ। মাওয়া ও জারিরা অ্যাপ্রোচ রোড ও সার্ভিস এরিয়ার কাজ শেষ হয়েছে শতভাগ।
দেখুন ভিডিও চিত্র:
https://www.youtube.com/watch?v=u-OHTm38T0M
সারাবাংলা/এমএনএইচ