Monday 02 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার কারণেই শিশুধর্ষণ-হত্যা বাড়ছে


১০ জানুয়ারি ২০১৯ ২১:৪৭ | আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৯ ২২:২৩
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।

ঢাকা: সম্প্রতি দেশে শিশুধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞ, সমাজকর্মী ও মানবাধিকারকর্মীরা। তারা বলছেন, শিশুর ওপর পৈশাচিক নির্যাতন আর হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধ-প্রতিকারে সমাজ ও রাষ্ট্রের উদাসীনতাই দায়ী। শুধু পরিবার বা সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেই এসব সমস্যার সমাধান হবে না। শুধু কঠোর আইন বা বিধান থাকলেই হবে না, যথাযথ প্রয়োগও করতে হবে। একইসঙ্গে শিশুদের জন্য আলাদা অধিদফতরও গঠন করতে হবে বলেও তারা মনে করেন।

শিশু নির্যাতনকারীদের নিপীড়নের শিকার হয়ে সর্বশেষ গত সোমবার (৭ জানুয়ারি) প্রাণ হারাতে হয় রাজধানীর ডেমরার কোনাপাড়া এলাকার মাত্র সাড়ে চার থেকে পাঁচ বছর বয়সী দুই শিশুর। ওই দুই শিশুর বন্ধুত্বকে ঘিরে দুই পরিবারের সখ্যও বাড়ে । একসঙ্গে খেলাধূলা–ওঠাবোস ছিল শিশু দুটির। আর এই মাসেই তাদের দুজনকে ভর্তি করা হয় একই স্কুলে। ঘটনার দিন তারা একসঙ্গে স্কুলেও যায়। ফিরে এসে খেলতে বের হয় তারা। কিন্তু খেলা শেষে তারা মায়ের কোলে ফিরে যায়নি। ফিরে এসেছে দুজনের লাশ।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন: দোলা ডাক্তার হতে চেয়েছিল, ডিপিএস করেছিলেন মা

এই প্রসঙ্গে বুধবার (৯ জানুয়ারি) ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘সেদিন লিপস্টিক দিয়ে সাজিয়ে দেওয়ার কথা বলে শিশু দুটিকে নিজেদের ঘরে ডেকে নেয় প্রতিবেশী গোলাম মোস্তফা (২৮) ও তার ভাই আজিজুল বায়ানি (৩০)। এরপর তারা ধর্ষণের চেষ্টা করলে শিশু দুটি চিৎকার করে। এসময় আসামিরা একটি শিশুকে গলা টিপে ও অন্যটির গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে তাদের লাশ ফেলে রাখে নিজেদের খাটের নিচে।’

জানতে চাইলে শিশু মনোবিজ্ঞানী ড. মনোয়ারা পারভীন জাহাঙ্গীরী বলেন, ‘সামাজিক অস্থিরতা চলছে সব খানে। মা-বাবর ব্যস্ততা, শিশুপালনের জন্য সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ আর নিরাপত্তাহীনতা-সবই বেড়েছে। একইসঙ্গে বেড়েছে মাদকাসক্তি। তার ওপর বিদেশি সংস্কৃতি আর ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সুস্থ–স্বাভাবিক পরিবেশের অভাবে সমাজে মানসিক বিকৃতির মানুষও বাড়ছে। বাড়ছে নারী আর শিশু নির্যাতন। আর এরই অংশ হিসেবে এখন আমরা দেখেছি ছোট শিশুরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, বাড়ছে গণধর্ষণ।’ তিনি আরও বলেন, ‘কর্মজীবীদের সন্তানরাও অনিরাপদ পরিবেশে বেড়ে উঠছে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত বাবা-মায়ের সন্তানরা। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে গার্মেন্টগুলোতে শিশুদের রাখার ব্যবস্থা (ডে-নাইট শিফট অনুযায়ী) রাখার ব্যবস্থা নেই। কর্মজীবী বাবা-মায়েদের শিশুদের পরিবেশের প্রটেকশন বা নিরাপদ জায়গা নেই।’

ডেমরার দুই শিশু হত্যাকাণ্ডের প্রভাব সমাজের প্রত্যেকটি শিশুর ওপর পড়বে মন্তব্য করে এই শিশু মনোবিজ্ঞানী বলেন, ‘যারা সরাসরি দেখবে, জানবে, তারা ছাড়াও যারা শুনবে বা টিভিতে দেখবে, তারাও আতঙ্কগ্রস্ত হবে। এসব ঘটনা তাদের মানসিক বিকাশে বাধা দেবে। তাদের আবেগের সুষম বিকাশ হবে না। মানসিক বিষণ্নতা কাজ করবে। যে কারণে তারা অকারণে ভয় পাবে। তার ওপর কোনো যৌন নির্যাতন হলেও তা প্রকাশ করতে ভয় পাবে। এসব কারণে সামাজিক আর রাষ্ট্রীয়ভাবে শিশুদের নিরাপত্তা উদ্যোগ নিতে হবে।’ গার্মেন্টগুলোতে ডে কেয়ার সেন্টারের পাশাপাশি সামাজিক সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে বলেও তিনি মনে করেন।

আরও পড়ুন: লিপস্টিক দেওয়ার কথা বলে

শিশু অধিকার ফোরামের সাবেক চেয়ারম্যান মো. এমরানুল হক চৌধুরী বলেন, ‘গত দশ বছর ধরে আমরা শিশু অধিকার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরত্ব দিতে বলছি সরকারকে। কিন্তু এর কোনো সাড়া পাইনি। এখনপর্যন্ত দেশে শিশুদের বিষয় দেখভালের জন্য কোনো নির্দিষ্ট কর্মকর্তা নেই। দেশে যদি একটি শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়, সেটিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু আমরা যখন অনেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে দেখি, তখনই কেবল তোড়জোড় শুরু করি। এরপরে তার কোনো ফলোআপ থাকে না। দ্রুত বিচার আইনে বিচার হলেও এর ফল খুব একটা প্রকাশ্যে দেখি না আমরা। শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনা বাড়াতে হবে। শিশুদের নিরাপত্তা দিতে উদ্যোগ নিতে হবে। শিশু অধিকার বিষয়ে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এটা সত্যি, শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে এখন ভালো আইন আছে। আইন প্রয়োগে এখন তৎপরতাও আছে। কিন্তু শাস্তির বিধানটা শক্ত নয়।’ সঠিক সময়ে সঠিক প্রয়োগ নেই বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

মো. এমরানুল হক চৌধুরীর মতে, ‘গ্রামে-শহরে শিশুদের নিরাপত্তায় সমাজের নেতৃত্বে থাকা মানুষরা এসব বিষয়ে উদাসীন। শিশু নির্যাতন বন্ধে শুধু সামাজিক আন্দোলন হলেই চলবে না। সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘শিশু কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি। এই কমিশনে শিশু অধিকার নিয়েই কাজ করবে। যারা গ্রাম-শহর সব খানেই কাজ করবে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালেয়ের অধীনে আলাদা শিশু অধিদফতর থাকবে। ১০ বছর ধরে এই চাওয়ার কোনো বাস্তবায়ন নেই।’

শিশু ধর্ষণ বন্ধে সামাজিক আন্দোলন জরুরি বলে মনে করেন মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট ফৌজিয়া করিম। তার মতে, ‘শুধু আসামি গ্রেফতার বা ফাঁসি দিলেই এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। ধর্ষকদের শাস্তি বা ফাঁসি দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না। গ্রাসরুট লেভেল থেকে প্রথমে কারণ বের করতে হবে। একটা সামাজিক আন্দোলন হতে হবে। চাইল্ড অ্যাবিউজ যিনি করছেন, তার ব্যাকগ্রাউন্ড দেখতে হবে। হয় পরিবার থেকে বা সঙ্গ থেকেও আসতে হবে। পরিবার আর স্কুলগুলোকে সচেতন হতে হবে। শুধু পুঁথিগত বিদ্যার পেছনে না ছুটে সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়াতে হবে। স্কুল-কলেজগুলোতে মনোবিদ (কাউন্সেলর) অবশ্যই থাকা জরুরি। শিশু-কিশোরদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল খুব দরকার। স্কুলগুলোতে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, গান, আবৃত্তি চর্চা বাড়াতে হবে। আর্টিফিয়াল ইনটিলিজেন্স থেকে বের করে তাদের সত্যিকারের মানসিক বিকাশে কাজ করতে হবে। ’

হঠাৎ করে সমাজে আকাশ সংস্কৃতি ঢুকে পড়া, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মতো বিষয় সোসাইটির ট্র্যাডিশনাল নর্মস- ভ্যালু থেকে বের হওয়ার প্রবণতা তৈরি করেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান। তিনি বলেন, ‘সবার কাছে ইন্টারনেট-ফেসবুক-পর্নগ্রাফি ওপেন হওয়ায় আমরা অনেকেই তা হজম করতে পারছি না। হঠাৎ করে পুঁজিবাদী সমাজ, নগরায়ণের ফলে সোসাইটি- স্কুল-কলেজের পরিবেশে অন্যরকম পরিবর্তন এসেছে। যেহেতু মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হচ্ছে, মাদকের বিস্তারও বাড়ছে। তাই সনাতন মূল্যবোধ থেকে আধুনিকতার পথে এগুতে গিয়ে কিছুটা টালমাটাল হয়ে পড়ছে। সনাতন অনুশাসন কাজ করছে না। মাদক চলে গেছে শহর ছেড়ে গ্রামে। মাদকের সহজলভ্যতা জীবন-যাপনে অনেক কিছুকেই ওপেন করে দিয়েছে। যে কারণে বিকৃত মানসিকতা পরিবর্তন হচ্ছে। আর এই বিকৃত মানসিকতার মানুষরাই সমাজের সবচেয় দুর্বল হিসেবে শিশুদের বেছে নিচ্ছে।’

অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘নতুন অনুশাসন বা সামাজিক কাঠামো তৈরীতে মনোযোগ দিতে হবে রাষ্ট্র-সমাজ সবাইকে। আইনের সুশাস ছাড়াও মাদকাসক্তদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। নতুন সামাজিক ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। অলটারনেটিভ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।’ দ্রুত এসব বিষয় এজেন্ডাভুক্ত করে সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে বলেও তিনি পরামর্শ দেন।

সারাবাংলা/জেডএফ/এমএনএইচ

শিশু ধর্ষণ-হত্যা শিশু নির্যাতন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর