আহমদ শফীর বক্তব্য ‘নারীশিক্ষাবিদ্বেষী’: বিচার দাবি বিশিষ্টজনদের
১৩ জানুয়ারি ২০১৯ ২১:১২
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: নারীশিক্ষা নিয়ে হেফাজতে ইসলামের আমির আহমদ শফীর বিতর্কিত বক্তব্যের জেরে চট্টগ্রামে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিশিষ্টজনরা এই বক্তব্যকে সংবিধান লঙ্ঘনের সামিল অখ্যায়িত করে আহমদ শফীর বিচার দাবি করেছেন। একইসঙ্গে সরকারের ‘হেফাজত তোষণের’ প্রতিবাদে রাজপথে নামারও চিন্তা করছে প্রগতিশীল বিভিন্ন সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠন।
প্রসঙ্গত, কওমি মাদ্রাসার ছয় বোর্ডের সমন্বিত সংস্থা আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়্যাহ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও হেফাজতের আমির আহমদ শফী শুক্রবার (১১ জানুয়ারি) এক মাহফিলে মেয়েদের সর্বোচ্চ ক্লাস ফোর বা ফাইভ পর্যন্ত পড়ানোর জন্য উপস্থিত অভিভাবকদের ওয়াদা করান। জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুইনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার ১১৮তম মাহফিলে তার দেওয়া বক্তব্য ভিডিওসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
এরপর শনিবার ওই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আবারও সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন আহমদ শফী। ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘ইসলামের একটি মৌলিক বিধান হচ্ছে পর্দা। নারীদের পর্দার বিষয় ইসলামে সুস্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে। আমি আমার বক্তব্যে বলতে চেয়েছি, শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে যেন পর্দার বিধান লঙ্ঘন করা না হয়। কারণ আমাদের দেশের বেশিরভাগ সাধারণ শিক্ষাকেন্দ্রে সহশিক্ষা দেওয়া হয়। অর্থাৎ ছেলে-মেয়ে একইসঙ্গে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। এতে পর্দার লঙ্ঘন হয়।’
দেশের নারীসমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে একের পর এক ‘বিতর্কিত’ বক্তব্য দেওয়ার সাহস আহমদ শফী কোথায় পেয়েছেন বলে প্রশ্ন তুলেছেন শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফী। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই ধরনের জঘন্য বক্তব্য একটি লোক দিনের পর দিন কীভাবে দিচ্ছেন? এত ধৃষ্টতা তিনি কোথায় পান? এত সাহস কোত্থেকে পান? যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকারসহ বড় বড় পদে নারীরা সগৌরবে অবস্থান করছেন, সেখানে এই ধরনের বক্তব্য প্রধানমন্ত্রীসহ পুরো নারী সমাজকে হেয় ও অবমাননা করার শামিল। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ক্ষমতার রাজনীতির কারণে আহমদ শফীদের মতো জঘন্য মানসিকতার লোকরা ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য পাচ্ছে। অথচ রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্যের জন্য তার এই রাষ্ট্রে থাকারই কোনো অধিকার নেই।’
নারীনেত্রী নুরজাহান খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই ধরনের জঘন্য, নোংরা বক্তব্য আহমদ শফী আগেও দিয়েছেন। সোজা কথা হচ্ছে, তার ঔদ্ধত্য সহ্য করার আর সুযোগ নেই। সরকার নারীশিক্ষার জন্য এতকিছু করছে, অথচ রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হয়ে রাষ্ট্রবিরোধী এই বক্তব্য দেওয়ার স্পর্ধা তিনি কোথায় পেলেন? তিনি কোন ক্ষমতাবলে ফতোয়া দেন এবং গ্রামের ধর্মভীরু লোকজনের কাছ থেকে ওয়াদা আদায় করেন? আমাদের মহানবী যেখানে নারীদের পড়ালেখাকে ফরজ বলে গেছেন, সেখানে শফী এই বক্তব্যের মাধ্যমে মহানবীর বক্তব্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর স্পর্ধা দেখিয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশের সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, প্রশাসনের সচিব, ডিসি, এসপি পর্যন্ত অনেক উচ্চপর্যায়ে নারীরা কাজ করছেন। আমি মনে করি, এই বক্তব্যের মাধ্যমে শফী দেশের পুরো নারীসমাজকে অপমান করেছেন। সব নারীর উচিত, শফী সাহেবের বিরুদ্ধে রাস্তায় দাঁড়ানো। তাকে এই বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।’ বারবার ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের জন্য শফীর বিচার করতে হবে বলেও দাবি জানান তিনি।
সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে আহমদ শফীর বিচার দাবি করেছেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে। এরপর আমরা যে সংবিধানটা পেয়েছিলাম, সেটাতেও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা এবং সবার জন্য সমান অধিকারের কথা বলা আছে। দুঃখজনক হচ্ছে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর শাসকগোষ্ঠী এই উগ্র ধর্মান্ধদের সমাজে ও রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আবার স্বাধীনতার পক্ষশক্তি যাদের বলা হয়, তারাও নানা সমীকরণের রাজনীতিতে ধর্মান্ধ শক্তিকে তোষণ করে চলছেন। এর ফলে আহমদ শফী এই ধরনের বক্তব্য দেওয়ার সাহস পাচ্ছেন। সংবিধান অমান্য করার দায়ে আহমদ শফী’র বিচার করা উচিত।’
এর আগে আহমদ শফী’র দেওয়া বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানান শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলও। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা হেফাজত আমিরের ব্যক্তিগত অভিমত। তবে এই অভিমত রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’ হেফাজত আমিরের বক্তব্য রাষ্ট্রীয় নীতিতে অন্তর্ভুক্ত বা প্রতিফলিত হবে না বলেও মন্তব্য করেন নওফেল।
সারাবাংলা/আরডি/এমএনএইচ