Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘এত আলোর শহরে কিসের ভয়?’


১৪ জানুয়ারি ২০১৯ ১৮:০৫

।। সিরাজুম মুনিরা, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর ।।

ঢাকা: একটা জরুরি কাজে কাওরান বাজার গিয়েছিলাম। কাজ শেষে দ্রুত অফিসে আসার জন্য মোবাইলে রাইড শেয়ারিংয়ের একটি অ্যাপে রিকোয়েস্ট দিলাম। বেশ অবাক করে দিয়েই স্ক্রিনে ফুটে উঠলো একটি নাম। যেখানে লেখা, মিনা বেগম।

নামটা দেখেই বেশ অবাক হলাম। ফোন করে জানতে চাইলাম, পুরানা পল্টনের দিকে যাবেন কি না। তিনি জানালেন, অবশ্যই। আমি যোগ করি, আমার বাড়তি ওজনের তথ্যটি। জানতে চাই, তিনি ও তার বাইক আমাকে বহন করতে পারবে কি না। কারণ, নারীরা সাধারণত স্কুটি চালান বলে জানি, যেটিতে ওজনের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে।

মিনা বেগম আমাকে আশ্বস্ত করলেন। জানালেন, তার বাইক বেশ ভালো। ভয়ের কোনো কারণ নেই।

একটু হেঁটেই তাকে পেয়ে গেলাম। পরনে ট্র্যাক স্যুট, চুল ছোট করে কাটা। দূর থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই তিনি নারী।

দেখা হতেই হেসে হেলমেট এগিয়ে দিলেন। সঙ্গে অভয়ও দিলেন। বললেন, কোনো ভয় নেই। দুই পাশে পা দিয়ে বসলে ভারসাম্যেরও কোনো সমস্যা হবে না।

এই শহরে দ্রুত যোগাযোগের জন্য বেশ কিছুদিন ধরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে রাইড শেয়ারিং সার্ভিসগুলো। মোটরসাইকেল চালিয়ে আয় করা এখন আয়ের একটা দারুণ উৎস হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে। অনেকেই নিজের দৈনন্দিন কাজ বা চাকরির পাশাপাশি বাড়তি সময়ে মোটরবাইক চালিয়ে বাড়তি উপার্জন করছেন।

বাসা আর অফিসের মধ্যে দূরত্বের কারণে প্রায়ই আমাকে রাইড শেয়ারিং সার্ভিসগুলোর শরণাপন্ন হতে হয়। গত ৬ মাসে যতবার বাইকে উঠেছি, তার সব চালকই ছিলেন পুরুষ। তবে অনেকের কাছেই শুনেছি, এখন নারীরাও নারী রাইড দিচ্ছেন। কিন্তু এই প্রথম আমি একজন নারী বাইকারের সঙ্গ পেলাম।

বিজ্ঞাপন

শুরু থেকেই দেখলাম দারুণ চালাচ্ছেন তিনি। প্রতিটি নিয়ম মানছেন। অযথা ওভারটেক বা লেন পরিবর্তন করছেন না। যে নিয়ম মানা পুরুষ রাইডারদের ক্ষেত্রে বেশ কমই দেখা যায়।

সংবাদকর্মী পরিচয় দিয়ে কথা বলি মিনা বেগমের সঙ্গে। জানতে চাই নানা বিষয়ে। অফিসের নিচে রাইড শেষ করে কথা বলি। জানাই, তাকে নিয়ে একটি স্টোরি করতে চাই। অনুমতি নিয়ে এক ফাঁকে ছবিও তুলি তার।

মিনা বেগম জানালেন, তিনি কুড়িগ্রামের মেয়ে। কুড়িগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেছেন। পাঁচ বছর আনসার বাহিনীতে কাজ করেছেন। তিনি মূলত একজন অ্যাথলেট। জাতীয় ফুটবল দলে খেলেছেন, খেলেছেন ক্রিকেট ও হ্যান্ডবল দলেও।

কোনো কারণে আনসার বাহিনী থেকে চাকরি হারান মিনা। একজনের পরামর্শে এরপর শুরু করেন খেলা নিয়ে পড়াশোনা। ‘নারী উদ্যোগ কেন্দ্র’র একটি বৃত্তি নিয়ে রাজধানীর শারীরিক শিক্ষা কলেজ থেকে বিপিএড ও এমপিএইড ডিগ্রি নেন। এখন চাকরি করছেন রাজধানীর উত্তরার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শারীরিক শিক্ষার প্রশিক্ষক হিসেবে।

অনেক বছর হয় বাবাকে হারিয়েছেন মিনা। ঘরে আছেন মা। সংসারে আরেকটু সচ্ছলতা আনতে চেয়েছিলেন। তখনই শুনলেন এসব রাইড শেয়ারিং অ্যাপের কথা। গত চার বছর ধরেই মোটরবাইক চালিয়ে স্কুলে যাওয়া আসা করতেন মিনা। দক্ষতা ছিল বেশ। তাই আর দেরি না করে রেজিস্ট্রেশন করে ফেলেছেন কয়েকটি অ্যাপে।

‘স্যালুট শাহনাজ আপা’

কেমন উপার্জন হয়, জানতে চাইলে মিনা জানান, প্রতিদিন সকাল ৭টা ৪০ থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত স্কুলে চাকরি করেন। এরপর বাইক নিয়ে বের হন। বেশিরভাগ দিনই রাত ৯টা পর্যন্ত চালান। এই আধাবেলায় গড়ে ৫০০ টাকা আয় হয়। আর শুক্র-শনিবার স্কুল বন্ধ থাকলে সারাদিনই চালাতে পারেন। এ সময় ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা আয় হয়। মাঝে মাঝে এর বেশিও হয় বলে জানালেন মিনা।

বিজ্ঞাপন

এবার জানতে চাই পথের দুর্ভোগ প্রসঙ্গে। মিনা বেগম জানান, এখন পর্যন্ত কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা হয়নি। যেহেতু নিয়ম মেনে গাড়ি চালান, তাই আইনি জটিলতায়ও কখনো পড়তে হয়নি। পুরুষ যাত্রীরাও খুব উৎসাহ দেন, কেউ এখনো অস্বস্তির কারণ হননি তার।

প্রতিমাসে পিরিয়ডের সময়গুলোতে বা দৈনন্দিন পথে শৌচাগার ব্যবহার নিয়ে সমস্যা হয় কি না, সে প্রশ্ন রাখি মিনার কাছে। জবাবে তিনি জানান, সাধারণত পেট্রোল পাম্পগুলোর টয়লেট ব্যবহার করেন তিনি। এছাড়া পথে কোথাও ক্রীড়া সংস্থা কার্যালয় পেলে সেখানেও চলে যান। নিজে যেহেতু অ্যাথলেট, ছিলেন আনসার সদস্য, সেহেতু যে কোনো পরিস্থিতিতে সহজেই মানিয়ে নিতে পারেন বলেও জানান তিনি।

স্কুটি নিয়ে ডিম পাহাড়ের চূড়া জয়!

পুরো যাত্রাপথে দেখেছি মিনার দক্ষ চালনা। জানতে পারি, ঢাকা থেকে এই মোটরবাইক চালিয়ে রংপুর যাওয়ার ইতিহাসও আছে তার।

কোনোদিন যাত্রী নিয়ে দূরে চলে গেলে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়। ভয় লাগে না? কৌতুহলের বশে জানতে চাই। দৃপ্তকণ্ঠে মিনা বলেন, ‘নাহ আপা, এত আলোর শহরে কিসের ভয়? প্রধানমন্ত্রী মেয়ে হয়ে দেশ চালাতে পারলে আমি সামান্য বাইক চালাতে পারবো না?’

একসময় গল্প ফুরায়, আমি অফিসের পথ ধরি। আমাকে নামিয়ে দিয়ে মিনা বেগম চলে যান তার উড়ালপঙ্খী নিয়ে। পেছন থেকে দেখি, তার মাথা উঁচু করে পথচলা। এই মিনা বেগমরাই তো সব কূপমণ্ডূক আর পশ্চাৎপদ মানুষদের জবাব দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। নারীদের ঘরে বসিয়ে রাখার পরামর্শ যারা দেন, তাদের সবার মুখে কি মিনা বেগমরা স্বয়ং চপেটাঘাত নন?

সারাবাংলা/এসএমএন/জেডএফ

উবার নারী বাইকার নারীর ক্ষমতায়ন পাঠাও সার্ভিস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর