Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘আন্দোলন করা’য় আশুলিয়ার মেট্রো নিটিংয়ের ২৮২ শ্রমিক ছাঁটাই!


১৫ জানুয়ারি ২০১৯ ২১:২৫

।। এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।

আশুলিয়া থেকে ফিরে: বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করায় আশুলিয়ার মেট্রো নিটিং অ্যান্ড ডাইং মিলসের (ফ্যাক্টরি-২) প্রায় তিনশ’ শ্রমিককে ছাঁটাইয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। মূল ফটকে কারখানা বন্ধের নোটিশ ঝোলানো থাকলেও মঙ্গলবার (১৫ জানুয়ারি) সকালে ওই কারখানার ভেতরে ছাঁটাইয়ের কার্যক্রম চলতে দেখা গেছে। বিষয়টি নিয়ে মূল ফটকের বাইরে চাপা ক্ষোভ নিয়ে ন্যায্য পাওনার অপেক্ষায় ছিলেন কয়েকশত পোশাককর্মী। সবার কণ্ঠেই ঝরছিল অক্ষেপের সুর। হটাৎ চাকরিচ্যুতিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

তবে কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, ছাঁটাই নয়, আইন ও নিয়ম মেনে ‘কর্তৃপক্ষীয় চুক্তি’র মাধ্যমে ২৮২ জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৪৪ জনের পাওনা মঙ্গলবারই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী বরখাস্ত হওয়া বাকি কর্মীদের পাওনাও শিগগিরই বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন: আশুলিয়ায় কাজে ফিরেছেন শ্রমিকরা

মঙ্গলবার সকালে আশুলিয়ার বেশকিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব করাখানায় কাজ চলছে।  সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে কোথাও কোনো আন্দোলন বা বিক্ষোভের খবর পাওয়া যায়নি। তবে, চারাবাগের মেট্রো নিটিং কারখানায়  দেখা গেছে, বাইরে কয়েকশত কর্মী অপক্ষো করছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় তিনশ কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে।

শ্রম আইন অনুয়ায়ী, মঙ্গলবারই সবার পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার কথা। কারখানাটির ভেতরে গিয়ে দেখা গেছে, উৎপাদন কাজ বন্ধ থাকলেও ছাঁটাইয়ের কার্যক্রম চলছে। রয়েছে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারও। দুই তলার একটি বোর্ড রুমে আশুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহ্বাজ শাহাবুদ্দিন মাতবর, ৪ নং ওয়ার্ড মেম্বার (চারাবাগ-কুমকুমারি) মোহাম্মদ হোসেন আলী মাস্টারসহ কয়েকজনকে মিটিং করতে দেখা গেছে।  ছাঁটাই কার্যক্রমে যেন মালিকপক্ষকে বেগ  পেতে না হয়, সেজন্য বাইরেও স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারের অনুসারীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।

বিজ্ঞাপন

মূল ফটকের বাইরে অপক্ষোরত মেট্রো নিটিংয়ের শ্রমিক আবির ইসলাম সুমন সারাবাংলাকে বলেন, ‘৭ জানুয়ারিতে ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমে আসেন। তখন থেকেই ফ্যাক্টরি বন্ধ। আজ কারখানায় এসে দেখি ছাঁটাইয়ের নোটিশ। ২৮০ জনকে ছাঁটাই করা হয়েছে।’

আরও পড়ুন: আশুলিয়ায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের কারখানা ভাংচুর

শরিফুল ইসলাম নামের আরেক কর্মী বলেন, ‘আন্দোলন তো সবাই করেছেন। তিন হাজার কর্মীই করেছেন। তিনশ কর্মীর বিরুদ্ধে মালিক পক্ষ মামলা করেছে বলে শুনেছি। এখন আমরা সবাই বেকার। বিনা কারণে ছাঁটাইয়ে পড়ে গেছি! পরিবার নিয়ে এখন কী করবো?’

অপারেটর পদে প্রতিষ্ঠানটিতে পাঁচ বছর ধরে কাজ করছিলেন সুমন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘৩য় গ্রেডে ডিসেম্বরে ৮ হাজার ৩৮২ টাকা বেতন পেয়েছি। জানুয়ারিতে পেয়েছি ৯ হাজার ৬৫২ টাকা। তাহলে আর বেতন বেড়েছে কোথায়? এ কারণেই আন্দোলন হয়েছে। অথচ এখন বেকার হয়ে গেলাম!’

২৮৫ জনকে ছঁটাইয়ের খবর জানতে পেরেছেন বলে জানিয়েছেন অপারেটর সুমন। কয়েকজন নারীকর্মীও একই রকম তথ্য জানিয়েছেন। আর সবার কণ্ঠেই তখন ছিল আক্ষেপের সুর।

সেখানে কর্মরত শিল্প পুলিশের এএসআই মনিরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘যারা গেঞ্জাম করেছে, তাদের বিদায় করে দেবে বলে আমরা জানতে পেরেছি। কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রস্তুতি চলছে বলেও আমরা দেখতে পেয়েছি।’

জানতে চাইলে আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেজাউল হক বলেন, ‘কিছু লোকের তো চাকরি যাবেই। যারা ভাঙচুর করেছেন, তাদের কি আর মালিক পক্ষ রাখবে?’ তবে কর্মী ছাঁটাইয়ের বিষয়টি জানা নেই বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন: আশুলিয়ায় শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে আহত ১০

এদিকে, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারের প্রতিবন্ধকতায় কারখানার ভেতরে ঢুকেও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে সুযোগ পাওয়া যায়নি।  পরে ছাঁটাইয়ে সহযোগিতার বিষয়ে মুঠোফোনে স্থানীয় ইউপি সদস্য মোহাম্মদ হোসেন আলী মাস্টার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের ভূমিকায় ছাঁটাই হবে কেন? আমরা এর সঙ্গে জড়িত নয়। ছাঁটাই করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।’

 একই বিষয়ে আশুলিয়ার ইউপি চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘আমার এলাকার বিষয়, তাই সেখানে অবস্থান করছিলাম। সেখানে আইনশৃঙ্খলার বাহিনীও ছিল। একটি মহল পোশাক খাতকে বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিতে চায়, তাই সেখানে অবস্থান নিয়েছিলাম।’

এদিকে, কর্তৃপক্ষের মন্তব্য জানতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অমল পোদ্দারের মোবাইলফোনে এসএমএস পাঠিয়ে ও কল করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে সারাবাংলার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। মেট্রো নিটিং অ্যান্ড ডাইং মিলসের জেনারেল ম্যানেজার (করপোরেট) আতিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন,  ‘কারখানায় কোনো ছাঁটাই করা হয়নি। ২৮২ জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে মঙ্গলবারই ২৪৪ জনের সব রকমের পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকিরা হয়তো গ্রামে আছেন। তাদের পাওনাও দ্রুত বুঝিয়ে দেওয়া হবে।’

বরখাস্তের কারণ ব্যাখ্যা করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘কর্তৃপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে শ্রম আইনের সব ধারা মেনে এসব কর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্তকৃতরা নিজেদের দোষ স্বীকার করে নিয়েছেন। তাদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। তাদের নামে যে মামলা করা হয়েছিল, শ্রমিক নেতারা বলেছিলেন সেই মামলা উঠিয়ে নিতে, সে হিসেবে বরখাস্তের এই চুক্তি হয়েছে।’

টেক্সটাইল গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে শ্রমিকদের ওপর মানসিক চাপ তৈরি করা হয়েছে। এতে ওই কারখানায় সুষ্ঠু পরিবেশ থাকবে না। মালিকদের প্রতি শ্রমিকেরা আস্থা হারাবেন।’

শ্রমিকদের আইনগত সহয়তা দেওয়ার কথা জানিয়ে এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের আইনগত সহায়তা দিতে আমি পুরো প্রস্তুত। কোনো কর্মী আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাদের চাকরি ফিরিয়ে দিতে আইনগত ব্যবস্থা নেব। চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।’

আশুলিয়ার মেট্রো নিটিংয়ে ছাঁটাইয়ের বিষয়ে কিছুই জানেন না তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রফতানিকারক ব্যবসায়ীদের সংগঠনের (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। তিনি মোবাইলফোনে সারাবাংলাকে বলেন, ‘আন্দোলন করলেই ছাঁটাই বা চাকরিচ্যুত করা হবে, বিষয়টি এমন নয়। যারা ভাঙচুর করেছেন, হয়তো তাদেরই ছাঁটাই করা হয়েছে।’ এছাড়া এটি তো যৌক্তিক আন্দোলন নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

ছবি: হাবিবুর রহমান
সারাবাংলা/ইএইচটি/এমএনএইচ

আশুলিয়া পোশাক শ্রমিক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর