হঠাৎ বেপরোয়া ছিনতাইকারী চক্র
১৮ জানুয়ারি ২০১৯ ১১:১১
।। উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: হঠাৎ করে রাজধানীতে বেপরোয়া হয়ে উঠছে ছিনতাইকারী চক্র। আতঙ্কের পর্যায়ে না গেলেও ছিনতাই বেড়ে যাওয়ায় নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে রাজধানীবাসী। মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত এমনকি দিনে-দুপুরেও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। অথচ খুন, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ছিনতাই প্রতিরোধে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কার্যত কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি বলে মনে করেন গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, গোয়েন্দারা ছিনতাই প্রতিরোধে তৎপর থাকলেও থানা পুলিশের দায়িত্ব অবহেলা রয়েছে।
ছিনতাইয়ের কবলে পড়া একজন পশু সরবরাহকারী হরমুজ আলী (৪৫)। প্রায় ২০ বছর ধরে রাজধানীর বিভিন্ন আড়তে খাসিসহ বিভিন্ন পশু সরবরাহ করে থাকেন। পরে সেখান থেকে তা মাংসের দোকানে সরবরাহ হয়ে থাকে। গত ১৬ জানুয়ারি বুধবার রাত ৭টায় টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে ৬৫টি খাসি নিয়ে যাত্রাবাড়ী আসছিলেন তিনি। এ সময় একটি ট্রাক এসে তার সামনে হাজির হয়। ট্রাকচালক তাকে বলে, তারা মধুপুর থেকে এসেছে। ঢাকায় আসবে চিনির জন্য। হরমুজ আরী ছাগল নিয়ে ঢাকায় আসতে চাইলে অল্প টাকাই আসতে পারবেন। এরপর ৩ হাজার টাকায় চুক্তি হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রওনা দেন তারা। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকার আমিন বাজার এলাকায় অস্ত্রের মুখে হরমুজ আলীকে বেঁধে ফেলে দিয়ে খাসির ট্রাক নিয়ে চলে যায় ছিনতাইকারীরা।
৬৫টি খাসি হারিয়ে বৃহস্পতিবার (১৭ জানুয়ারি) সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে হরমুজ আলী বলেন, ‘ট্রাকে ড্রাইভারসহ মোট ৫ জন ছিল। আর একজন লেবারসহ হরমুজ আলীরা দুই জন ছিলেন। আমিন বাজারে ঢোকার আগে থেকে তাদের সন্দেহ হচ্ছিল। তবে এরকম ঘটনা ঘটাবে তা বুঝতে পারেননি। হঠাৎ চলন্ত গাড়ি সাইড করলো ছিনতাইকারীরা। ব্যাগ থেকে দেশীয় ছুরিসহ দুজনের গলায় রাম দা ধরলো। আর কয়েকজন দুই হাত পেছনমোড়া করে বেঁধে ফেললো। গামছা দিয়ে একজনের চোখ বেঁধে দুই জনকেই ট্রাক থেকে রাস্তার পাশে ফেলে দেয় তারা। এরপর গাড়ি ঘুরিয়ে সাভারের দিকে চলে যায়।
হরমুজ আলী বলেন, ‘খাসিগুলোর মূল্য ছিল ৬ লাখ টাকা। প্রায় ২০ বছর ধরে এই ব্যবসার সঙ্গে আছি। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশসহ অনেক জায়গায় খাসি সরবরাহ করে করেছি। কোনোদিন এরকম ঘটনা ঘটেনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘হাত বাঁধার সময় তারা মারধরও করেছে। এ ঘটনার সময় ওই এলাকায় কোনো পুলিশ ছিল না।’ এ ঘটনার পর বৃহস্পতিবার সকালে তিনি সাভার মডেল থানায় অভিযোগ করতে যান। কিন্তু পুলিশ অভিযোগ না নিয়ে জিডি নেয় বলেও তিনি জানান।
এদিকে, মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) ভোর সাড়ে ৫টার দিকে গেন্ডারিয়ার লোহারপুল এলাকা থেকে রিকশায় কমলাপুর রেল স্টেশনে যাওয়ার সময় ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। তিনি গ্রামের বাড়ি রাজশাহী যাচ্ছিলেন। মুহূর্তেই চলে যায় তার ভ্যানিটি ব্যাগ। ট্রেনের টিকিট, টাকা পয়সাসহ সব। এ ঘটনার পর ওই শিক্ষার্থী থানায় যাননি। তিনি স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরে বাড়িতে চলে যান।
ওই শিক্ষার্থী মোবাইল ফোনে সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনাটি ঘটেছে মুরগীটোলা মোড়ে। সেখানে কোনো পুলিশ ছিল না। থানায় যাইনি একারণে যে, ঝামেলা করতে চাইনি। আমি নারী। থানায় গিয়ে অভিযোগ করার পর বারবার এ বিষয় নিয়ে ঝামেলা হবে। তাই যাইনি।’ তিনি বলেন, ‘কোন এলাকায় কে ছিনতাই করে, তা তো পুলিশ জানেই। মাঝখানে তো ছিনতাই হয়নি।’ এখন কেন হচ্ছে, তা পুলিশই ভালো জানে বলেও যোগ করেন তিনি।
এর আগে, গত ১১ জানুয়ারি রাতে মিরপুর মডেল থানা এলাকা থেকে ৬ ছিনতাইকারীকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এই প্রসঙ্গে পুলিশ জানায়, ‘ওইদিন রাত পৌনে নয়টার দিকে তারা ছিনতাইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ সময় তাদের কাছ থেকে দুইটি চাপাতিসহ দেশীয় অস্ত্র জব্দ করা হয়। তারা হলো, গৌতম রাজবংশী, মো. আব্দুস সালাম, সুব্রত কুমার ঘোষ ওরফে মো. শুভ, সুব্রত কুমার দত্ত, মো. মাসুদ রানা ও মো. মহিন।
এই প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ডিবি উত্তর) শাহজাহান সাজু বলেন, ‘মিরপুর, কল্যাণপুর, টেকনিক্যাল, গাবতলী বাসস্ট্যান্ডসহ মহানগরীর বিভিন্ন জন-কোলাহলপূর্ণ স্থানে প্রতিনিয়ত ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আসে। জানা গেছে, ছিনতাইকারীরা কখনো মোটরসাইকেল, কখনো প্রাইভেটকার বা মাইক্রোবাস যোগে পথচারী বা রাস্তায় অপেক্ষমাণ ব্যক্তির কাছ থেকে মূল্যবান সামগ্রী, ভ্যানিটি ব্যাগ, গলার চেইন, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। এক্ষেত্রে দূরদূরান্ত থেকে আসা পথচারী ও নাগরিকদের মনে সার্বক্ষণিক একটি ভীতি ও আতঙ্ক বিরাজ করে। বিষয়টিকে মাথায় রেখে গোয়েন্দা উত্তরের গুলশান জোনাল টিম কাজ শুরু করে। এই ছিনতাইকারীদের ধরেও ফেলে।
অন্যদিকে, ১৬ জানুয়ারি ভোর সাড়ে ৪টার দিকে রাজধানীর পুরানা পল্টন মোড় থেকে তিন ছিনতাইকারীকে আটক করে র্যাব-৩-এর একটি দল। তারা হলো, বিল্লাল হোসেন, রাশেদ আলী ও আব্দুস সালাম। র্যাব-৩-এর সিও (কমান্ডিং অফিসার) লে. কর্নেল এমরানুল হাসান বলেন, ‘পল্টন মোড়ে তারা ভোরের দিকে ছিনতাইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ সময় তাদের কাছ থেকে দেশীয় অস্ত্র পাওয়া গেছে। গ্রামের বাড়ি থেকে বাসে কিংবা অন্যকোনো যানবাহনে এসে ঢাকায় নেমে বাসায় যাওয়ার পথে যাওয়া পথচারীরা এই ছিনতাইকারীদের শিকার হন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ছিনতাইয়ের মতো ঘটনায় দায়সারা তদন্ত ও অপরাধের গুরুত্ব কম দেখানোর প্রবণতা রয়েছে থানা পুলিশের। শুধু সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হিসেবে ছিনতাইয়ের ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়।’ থানা পুলিশের সদস্যদের নগরীতে টহলের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে ছিনতাই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ‘সম্প্রতি রাজধানীতে ছিনতাই কিছুটা বেড়েছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা জানতে পারছি। পুলিশ সদস্যদের অন্য একটি বড় ইভেন্টে ব্যস্ত থাকার পর রাস্তায় থানা পুলিশের টহল কিছুটা কম হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তৎপর রয়েছে।’ নগরবাসী কীভাবে আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে চলাফেরায়, তার জন্য কাজ করা হবে বলেও তিনি জানান।
সারাবাংলা/ইউজে/এমএনএইচ