Friday 11 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্টপেজে থামছে না বাস, যত্রতত্র উঠা-নামা করছে যাত্রী


১৮ জানুয়ারি ২০১৯ ২৩:২৪

।। সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: বৃহস্পতিবার (১৭ জানুয়ারি) দুপুর দেড়টা। রাজধানীর সড়কজুড়ে থেমে থাকা গণপরিবহনসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের দীর্ঘ সাড়ি। ট্রাফিক জ্যামে আটকে নাভিশ্বাস উঠছে যাত্রীদের। কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা বললে তারা অভিযোগ করলেন, দীর্ঘদিনের অভ্যাসে স্টপেজ ছাড়াই যত্রযত্র বাস দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামার ঘটনা থেমে নেই। অনেক ক্ষেত্রে বরং স্টপেজ নয়, এর আগে-পরের স্থানগুলোতেই দাঁড়িয়ে যায় বাস। ফলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে গত কয়েকমাসের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো ট্রাফিক পুলিশ মাঠে নামলেও তার সুফল মিলছে না।

বিজ্ঞাপন

রাজধানীতে বাসের যত্রতত্র থামানো ও যাত্রী ওঠানামার চিত্র সরেজমিনে দেখতে গুলশানের নতুনবাজার এলাকা থেকে পিছু নিয়েছলাম তুরাগ পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো-ব-১৪১৮৪৯) একটি বাসের। থামলাম সায়েদাবাদ গিয়ে। প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথের ওইটুকু সড়কে স্টপেজ ছিল ছয়টি। অথচ যাত্রাপথে প্রায় ৩২টি স্থানে থামে বাসটি। প্রতিবারই যাত্রী ওঠানামা করে সড়কেই মাঝেই। একবারের জন্যও নির্ধারিত কোনো স্টপেজে দাঁড়ায়নি বাসটি।

যাত্রাপথে দেখা যায়, নতুন বাজার থেকে বাসটি বাড্ডা লিংক রোড, মধ্য বাড্ডা ও রামপুরা ব্রিজে এসে এমনভাবে দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলেছিল যে পেছন থেকে অন্য গাড়িগুলো যাওয়ার রাস্তাও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ওই গাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত শত গাড়িকে আটকে থাকতে হয়। অথচ ওইটুকু রাস্তাতেই দুইটি বাস স্টপেজ ছিল। স্টপেজে দাঁড়ালে অন্য বাস বা যানবাহনগুলো নিজেদের পথে চলার সুযোগ পেত।

একইভাবে খিলগাঁও রেলগেট, আনসার ক্যাম্প, বাসাবো, মুগদা ও সায়েদাবাদ মানিকনগর এলাকার আরও পাঁচটি বাস স্টপেজ অতিক্রম করলেও সেসব স্থানে থামেনি বাসটি। প্রতিটি স্টপেজের আগে বা পরের কোনো স্থানে ওঠানামা করতে হয় যাত্রীদের। এসময় রামপুরা ব্রিজ, খিলগাঁও রেলগেট, বাসাবো ও মানিকনগর এলাকায় চারটি ট্রাফিক স্পট অতিক্রম করলেও কোনো মামলা কিংবা জরিমানার শিকার হয়নি বাসটি। এমনকি কোনো ট্রাফিক পুলিশও বাসটিকে থামায়নি একবারের জন্যও।

বিজ্ঞাপন

বাসটি সায়দাবাদ গিয়ে থামলে কথা হয় চালক রফিক মিয়ার সঙ্গে। জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, টঙ্গী স্টেশন রোড থেকে বাস চালিয়ে আসছি। প্রতিবারই স্টপেজে থামাইছি।

কিন্তু তাকে অনুসরণ করে আসা পথে তিনি একবারও স্টপেজে বাস থামাননি এবং সে চিত্রও ক্যামেরায় ধারণ করা আছে— এ কথা বললে রফিক মিয়া বিনয়ের সুরে বলেন, ‘মামা, মাফ কইরা দেন। বুঝেনই তো, যাত্রীরা যেখানে নামতে চায় সেখানে নামাতে হয়। নাইলে ঝামেলা করে তারা। আর কখনও এমন হবে না।’

এদিকে, বাসটি মুগদা অতিক্রম করার সময় একটি মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। দু’জন ট্রাফিক পুলিশ সেখানেই ছিলেন। বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেলের চালকের হেলমেট কিছুটা ভেঙে যায়। বড় দুর্ঘটনা না হলেও বাসটি আটকানোর চেষ্টা দেখা যায়নি সেখানকার ট্রাফিক পুলিশদের মধ্যে। বাসটিও দ্রুতই ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যায়।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত ট্রাফিক পুলিশ সদস্য মফিজুল বরং এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘দেখছেন কত মামলা-জরিমানা, তারপরও কোনো নিয়ম মানতেছে?’ আপনারা তো কোনো ব্যবস্থা নিলেন না— এমন প্রশ্ন করলে ট্রাফিক পুলিশের দুই সদস্য হেসে দিয়ে বলেন, ‘আর কত বলেন? যতক্ষণ তারা নিজেদের ভালো না হবে, যতই চেষ্টা করি কাজ হবে না।’ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে তাদের হতাশার প্রতিধ্বনিই ফুটে ওঠে তাদের কথায়।

সুনির্দিষ্টভাবে তুরাগ পরিবহনের ওই বাসটিতে পুরো রাস্তা অনুসরণ করে এলেও সড়কের অন্যান্য গণপরিবহনের চিত্রও প্রায় একই। রাস্তায় যেতে যেতে যতগুলো গণপরিবহন চোখে পড়েছে, হাতেগোনা দুয়েকটি ছাড়া বাকি সবগুলোই তুরাগ পরিবহনের এই বাসটির মতোই থেমেছে স্টপেজের বাইরে কোনো স্থানে। যাত্রীদেরও যত্রতত্র নামিয়ে দিয়েছে, হাত তুললেই বাস থামিয়ে তুলেছে যাত্রী। ট্রাফিক পুলিশের ঘোষণা অনুযায়ী ১৫ জানুয়ারি থেকে ট্রাফিক পক্ষ শুরু হলেও গণপরিবহনের চলাচলে তার কোনো প্রতিফলই দেখা গেল না এদিন।

গত বছর নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে একবার ট্রাফিক সপ্তাহ ও একবার ট্রাফিক সচেতনতা মাস পালন করে ট্রাফিক পুলিশ। কয়েকমাস পর নতুন বছরের শুরুতে গত ১৫ জানুয়ারি ফের শুরু হয় ট্রাফিক পক্ষ, চলবে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। এসময় ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরাও সড়কে বিশৃঙ্খলা রোধে কাজ করবে। কিন্তু দু’দিন পেরিয়ে গেলেও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরার কোনো নমুনা দেখা যায়নি। এ দু’দিনে ট্রাফিক পুলিশকেও দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।

বাসাবো ফ্লাইওভার এলাকায় দেখা গেল তেমনই নমুনা। সেখানে ফ্লাইওভারে ওঠার প্রায় ১০০ গজ আগে হলুদ রঙ দিয়ে মার্ক করে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা ‘বাস স্টপেজ’। কিন্তু কোনো বাস সেখানে থামে না। দুপুর সোয়া ২টার সময় মোহাম্মদপুরে ডিউটিতে যাওয়ার জন্য মোসলেহ উদ্দিন নামের একজন ট্রাফিক পুলিশ বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।

স্টপেজে না দাঁড়িয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন— প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নে মোসলেহ উদ্দিন বলেন, ‘স্টপেজে অনেক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু বাস সেখানে থামে না। সব বাস এখানে এসে থামে।’ আপনি ট্রাফিক পুলিশ হয়েও কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে দাঁড়িয়ে কেন দেখছেন— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে আমার ডিউটি না। আমার ডিউটি মোহাম্মদপুর। কিন্তু সবখানেই তো এমন অবস্থা। মামলা খেলেও কোনো নিয়ম মানে না।’ বলেই লাইব্বাইক পরিবহনে উঠে চলে যান তিনি।

ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘ দিনের অনিয়মে অভ্যস্ত নগরবাসীকে নিয়মে ফেরাতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে শৃঙ্খলা ফিরবেই। এজন্য যা কিছু প্রয়োজন, সব করতে প্রস্তুত ট্রাফিক পুলিশের সাড়ে চার হাজার সদস্য।

তবে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারাবছর ধরে ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করার পরও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে না যদি স্থায়ীভাবে অবকাঠামোগত সমস্যা নিরসন না করা হয়। তাদের মত, ট্রাফিক পুলিশ যা করছে তাতে মানুষ নিয়ম সম্পর্কে অবগত হবেন, কিন্তু মানবেন না। পুরো সিস্টেমে সমস্যা রেখে কেবল সড়ক ব্যবহারকারী যাত্রী ও চালকদের ধরে জরিমানা এবং অর্থদণ্ড দেওয়ার যে নিয়ম চলছে, এটি একসময় মানুষের কাছে হাস্যকর হয়ে যাবে। তাই কেবল ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ না করে পুরো সিস্টেমের টেকসই সমাধান করার প্রতি জোর দেওয়ার আহ্বান জানান বিশেষজ্ঞরা।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামছুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিস্টেমটাকে বিশৃঙ্খল রেখে পরিবহন বা যাত্রীদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফেরাতে গত একবছরে তো কতকিছুই হলো। মামলা-জরিমানার তো রেকর্ড হয়েছে। কিন্তু রোগী তো সুস্থ হলো না। কারণ সিস্টেমটাই এখনও ডেভেলপ হয়নি। এই সিস্টেম যতদিন পর্যন্ত কারেকশন করা না হবে, ততদিন কোনোভাবেই সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হবে না।’

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে এই গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে টেকসই সমাধান আনতে চাইলে কেবল বাস নয়, রিকশায় নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে, মোটরসাইকেলের সংখ্যাতেও নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। প্রাইভেট কার, মিনিবাস, লেগুনাসহ অন্যান্য পরিবহনকেও নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। আর ফুটপাতের কথা তো বলাই বাহুল্য। কঠোরভাবে দায়বদ্ধ থেকে কাজ করলে এটা অসম্ভব কিছু না। সেটা না করতে পারলে ট্রাফিক পক্ষ ঘোষণা দিয়ে, ম্যাজিস্ট্রেট নামিয়ে অভিযান চালিয়ে যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সেটি একসময় মানুষের কাছে হাস্যকর হয়ে যাবে।

জানতে চাইলে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) মোসলেহ উদ্দিন আহমদে সারাবাংলাকে বলেন, নির্ধারিত স্থানে যাত্রী উঠানামার জন্য বাস মালিক-শ্রমিকদের আলোচনার মাধ্যমে সচেতন করা হচ্ছে। তারা নিয়মন মানতে শুরু করেছেন। ধীরে ধীরে উন্নতি হবে। আমরা এরই মধ্যে প্রায় ১৫৫টি বাস স্টপেজ মার্কিং করে দিয়েছি। সেসব স্থানে বাস থামছে। তবে কেউ কেউ এখনও বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করছে। তাদেরও সচেতন করতে ট্রাফিক পক্ষ চলছে। দীর্ঘ দিনের অনিয়মে অভ্যস্ত নগরবাসীকে নিয়মে ফেরাতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে শৃঙ্খলা ফিরবেই।

সারাবাংলা/এসএইচ/টিআর

যত্রতত্র উঠা-নামা করছে যাত্রী স্টপেজে থামছে না বাস

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর