চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি ‘গ্রহণযোগ্য’ নয়, ব্যবস্থা নেবে মন্ত্রণালয়
২২ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৪৪
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ঢাকাসহ ৮ জেলার হাসপাতালে অধিকাংশ চিকিৎসককে অনুপস্থিত পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরমধ্যে খোদ রাজধানীর হাসপাতালগুলোয় ৪০ শতাংশ এবং উপজেলা পর্যায়ে প্রায় ৬২ শতাংশ চিকিৎসকের অনুপস্থিতি দেখা গেছে। বিষয়টিকে চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনৈতিক। তাদের মতে, এটা ‘অন্যায়-গ্রহণযোগ্য’। আর মন্ত্রণালয় বলছে, চিকিৎসকদের এই অনুপস্থিতির বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চিকিৎসকের হাসপাতালে পাওয়া না যাওয়ার বিষয়টি মোটামুটি এতদিন ‘ওপেন সিক্রেট’ হলেও দুদকের অভিযানের পর বিষয়টি সবার সামনে আসে। এর আগে একাধিকবার সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম চিকিৎসকদের হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে চিকিৎসকদের সর্তক করেছেন। এছাড়া গত ২৩ অক্টোবর উচ্চ আদালত সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের উপস্থিতি-অনুপস্থিতির তালিকা হলফনামা আকারে দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ নিয়ে একাধিকবার কথা বলেছেন। গত ৭ অক্টোবর বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের চিকিৎসক সম্মেলনে তিনি বলেছেন, নতুন পদ সৃষ্টি ও নিয়োগ দেওয়ার পরও উপজেলা হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। ৫০ বেডের একটি হাসপাতালে কমপক্ষে ১০ জন চিকিৎসকের থাকার কথা। তবে, কোথাও একজন, কোথাও খুব বেশি হলে চারজন থাকছেন।
ওই সম্মেলনের ঠিক পরদিনই বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসক না থাকাকে অত্যন্ত দুঃখজনক বলেও মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এমন জায়গা রয়েছে যেখানে অপারেশন থিয়েটার পড়ে আছে, কিন্তু অপারেশন করার মতো ডাক্তার নেই, সার্জন নেই, নার্স নেই। আমরা শুধু প্রতিষ্ঠান করে যাব, কিন্তু সেগুলো অবহেলিত থাকবে, এটা কিন্তু হতে পারে না।
সর্বশেষ সোমবার ( ২১ জানুয়ারি) বেলা দুইটা পর্যন্ত মুগদা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, ফুলবাড়িয়ার কর্মচারী কল্যাণ হাসপাতাল, নাজিরা বাজারের মা ও শিশু সদন, রংপুরের পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, দিনাজপুর সদর হাসপাতাল, টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পাবনা সদর হাসপাতাল ও আটঘরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অভিযান চালায় দুদক।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) রেজিস্টার জাহিদুর রহমান বসুনিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘‘এটা তো অবশ্যই অন্যায় কাজ। ‘দে আর পেইড ফর দ্যাট, তারা টাকা নিচ্ছে, কিন্তু উপস্থিত থাকবে না’—এটাতো অন্যায় আচরণ নিঃসন্দেহে। তাদের ওপর যে দায়িত্ব ছিল, চিকিৎসাসেবার জন্য রোগী আসছে, অথচ তারা সেবা পাচ্ছে না, এটা তো আনফরচুনেট।’’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি বলতে চাই, এটা অনৈতিক, আনএথিক্যাল ও আন ল’ফুল। খুবই দুঃখজনক।’’
তবে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব সারাবাংলাকে বলেন, ‘চিকিৎসকরা উপস্থিত থাকেন না, এটা তো অস্বীকার করার কোনও কারণ নেই। কিন্তু এর সমাধান কী সেটা খুঁজে বের করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকরা কি কাজের জায়গা নিয়ে সন্তুষ্ট নন? কাজের সুযোগ সুবিধা রয়েছে না কি অন্য কোনও কারণ রয়েছে, সেটা আগে বের করতে হবে।’
অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘‘হেলথ সার্ভিস সিস্টেমে কোনও সমস্যা রয়েছে কি না, তাও দেখতে হবে। ‘অ্যাপোয়েন্টমেন্ট-ওয়ার্ক সেটিসফেকশন-জবাবদিহিতা’ সবকিছু মিলিয়ে দেখতে হবে।’ তারা কেন যাচ্ছেন না, তা নিয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে বলেও তিনি মত দেন।
এই প্রসঙ্গে দুদকের এনফোর্সমেন্ট দলের সমন্বয়ক ও প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক (প্রশাসন) মুনীর চৌধুরী জানান, অভিযান পরিচালনার সময় রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসকদের কাজের রোস্টার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২৩০ জন চিকিৎসকের মধ্যে ৯২ জনই অনুপস্থিত। যা মোট চিকিৎসকের ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে, ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে দেখা গেছে, ১৩১ জন চিকৎসকের মধ্যে অনুপস্থিত ছিলেন ৮১ জন। যা মোট চিকিৎসকের প্রায় ৬২ শতাংশ।
আরও পড়ুন: ১০ হাসপাতালে দুদকের অভিযান, ৯২ চিকিৎসক অনুপস্থিত
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব আসাদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চিকিৎসকদের বারবার বলেছি, তাদের সর্তক করেছি। কিন্তু কাজ হয়নি। এবার আমরা ব্যবস্থা নেব।’
কী ধরনের ব্যবস্থা নেবেন—জানতে চাইলে আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথমে তাদের শোকজ করা হবে। তারা কেন উপস্থিত থাকেন না, তার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে কি না, জানতে চাইব।’ তিনি আরও বলেন, ‘অননুমোদিত অনুপস্থিত কি না, সেসব কিছু খতিয়ে দেখা হবে। সেটা তদন্ত করে হোক বা তাদের রিপোর্ট দেখে হোক।’
তবে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যবস্থা না নিলে তো সেটা আমাদের ব্যর্থতা হবে। এছাড়া ম্যানেজমেন্টের জন্য বিষয়টি কঠিন হয়ে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এত কিছু জানার পরও যদি আমরা ব্যবস্থা না নিতে পারি, তাহলে আরও বেশি বিশৃঙ্খলা বাড়বে।’
মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি করেছে কি না, জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘আমরা তো এখন পর্যন্ত গণমাধ্যম থেকে এ বিষয়ে জেনেছি। দুদক থেকে এ সংক্রান্ত রিপোর্ট পেয়ে যাবো। দুদক থেকে আমাদের অ্যাটেনডেন্স নিয়ম রয়েছে, অফিসের বিধি-বিধান রয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে বিভাগীয় প্রসিডিং-প্রসিডিউর রয়েছে। সেগুলো অবশ্যই মানতে হবে, না মানলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে, চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি নিয়ে বিষয়টিকে অত্যন্ত ‘বিব্রতকর ও লজ্জাজনক’ আখ্যা দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে পরিচালক (হাসপাতাল অ্যান্ড ক্লিনিক) অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘‘জাতির কাছে আমাদের লজ্জার কোনও শেষ নেই। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে অত্যন্ত বিব্রতবোধ করছি। এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ‘ডিরেক্টর অব হসপিটাল’ হিসেবে আমার লজ্জার শেষ নেই।’’
স্বাস্থ্য অধিদফতরে পরিচালক বলেন, ‘‘চিকিৎসকরা চাকরি করবেন, বেতন নেবেন কিন্তু অনুপস্থিত থাকবেন—এটা মেনে নেওয়া যায় না। ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রণালয় থেকে এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে দুটি সেল করা হয়েছে।’ এই সেলের সদস্যরা চিকিৎসকদের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি ‘ক্লোজলি মনিটর’ করবেন বলেও তিনি জানান।
সারাবাংলা/জেএ/ এমএনএইচ/আরএসও